সময়
বড় ডুকরে ডুকরে কাঁদছে
চিত্তরঞ্জন
হীরা
মাঝে মাঝে সময় মনের উপর ভীষণ প্রভাব ফেলতে শুরু করে। শুধু সময় কেন, জীবনেও এমন অনেক ঘটনা ঘটে, তার অভিঘাতও ব্যক্তিবিশেষে কম নয়। তাতে কেউ কেউ তীব্র প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠতে পারেন, আবার কেউ একেবারে নির্বাক হয়ে যান। তবে নির্বিকার নয়। একে ঠিক আত্মমগ্নতা বলা যাবে কিনা জানি না। ক্ষরণ বলা যেতে পারে। আত্মক্ষরণ হয়। ভেতরের কান্নাগুলো ভেতরেই বইতে থাকে। কখনও কখনও বাজতেও চায়। এই বেজে ওঠার মধ্যেই হয়তো সাহিত্যের রসদ থেকে যায়। কারও কারও সত্তায় সেই প্রভাব ভাষায় প্রকাশ পেয়ে প্রতিবাদ- প্রতিক্রিয়ার নিদর্শন হয়ে উঠতে পারে। কাউকে ঠিক সেভাবে বোঝানো যাবে না, এটা অনুভবের বিষয়।
অতীতের
একট ঘটনার কথা বলতে ইচ্ছে করছে। অনেকেরই মনে পড়বে হয়তো। তখন ১৯৯৭ সাল। কলকাতা
বইমেলার ঘটনা। তারিখটা সম্ভবত ৩ ফেব্রুয়ারি। দুপুর দুটো নাগাদ বইমেলায় আগুন লাগল।
তখনও মানুষের ভিড় ততটা জমে ওঠেনি, তবুও নেহাত কম নয়। মুহূর্তে ফিসফাস, তারপর
অস্থিরতা বাড়ছে। প্রথমে ততটা গুরুত্ব দিই নি। এত বড় মেলা, এত মহা ব্যবস্থা!
ভেবেছি নিশ্চয়ই কর্তৃপক্ষ সব সামলে দেবে। আমার সাথীরা আগুনের ছড়িয়ে পড়া প্রত্যক্ষ
করলো। একরকম জোর করেই আমাকে আমাদের নিজস্ব স্টল থেকে টেনে বের করলো এবং স্টলের
বইপত্র অতি কষ্টে বাঁচিয়ে নিয়ে আগুন থেকে নিরাপদ দূরত্বে চললো। বেরোবার আগে একবার অবশ্য
ভেতরে অন্যান্য বন্ধুদের সাহায্য করার জন্যে ঢুকতে চেষ্টা করেছিলাম। আগুন বাঁধা
দিল। আগুনের লেলিহান আর চারপাশের মানুষের আর্ত চিৎকার বাড়ছে। দেখছি চোখের সামনে
দাউ দাউ করে পুড়ছে সভ্যতা, পুড়ছে অমূল্য সব গ্রন্থ, ছবি, ইতিহাস, যাবতীয় সব। কিছুই
করার রইলো না। ফায়ার ব্রিগেডের আপ্রাণ চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে। যতটা না আগুন নিভছে
তার চেয়ে জলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মূল্যবান বইপত্র। মাত্র আড়াই ঘণ্টায় কলকাতা
পুস্তকমেলা পরিনত হল ভষ্মভূমিতে। এর মধ্যেও সাংবাদিক ফটোগ্রাফারদের এক্সক্লুসিভ
ছবি নেওয়ার ধুম আর খবরের সন্ধানের কী নিরলস প্রয়াস ! একটি বইও তারা বাঁচাতে চেষ্টা
করছে না। উপরন্তু ফায়ার ব্রিগেডের যে গাড়ি আগুন নেভাতে ভেতরে ঢুকতে পারছে না, তারা
সেই গাড়ির উপর উঠে ক্রমাগত খবর খুঁজে চলেছে। এর সঙ্গে রয়েছে বইচোরের দল। তারাও
সুযোগে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব দেখতে দেখতে আমার ভেতরটা কেমন অন্যরকম এক
অনুভূতিতে দগ্ধ হচ্ছে। বিবেকের দংশন হচ্ছে। একটু একটু করে পশ্চিম আকাশে
সূর্যাস্তের ছায়া। কিন্তু তখনও ধোঁয়া আর ধোঁয়া। পোড়াগন্ধে বাতাস মাতছে। ধোঁয়ার
কুণ্ডলীর মধ্যে অভাগীর স্বর্গ খোঁজার মতো তাকিয়ে রয়েছি যেন সেইদিকে। স্টলমালিক,
প্রকাশকদের আর্ত চিৎকার, হাহাকার তখনও। অন্ধকার নেমে এল ব্রিগেড প্যারেডের বুকে।
সাথীরা বলছে– দাদা, চলুন বাড়ি যেতে হবে। আমি তাকিয়ে সব হারানোর দিকে।
অনেক
কষ্টে বাড়ি ফিরে টানা তিনদিন কারও সঙ্গে কথাই বলতে পারিনি। কারও খবর নিতে ইচ্ছেও
করেনি। ভাবছি, যা গেল, তাতো কোনোদিন ফিরবে না। কিন্তু আমাদের ক্ষতির পরিমাণ ছিল
যৎসামান্য। সে অর্থে বলতে গেলে কোনও ক্ষতিই হয়নি। আমার সঙ্গীরা সব বাঁচিয়ে নিয়েছিল
সেদিন। যাহোক, একসপ্তাহ ধরে সরকার এবং গিল্ড-এর অভাবনীয় তৎপরতায় আবার মেলা জেগে
উঠলো বইপোড়া ছাই সরিয়ে। যেন ধ্বংসস্তূপের উপর আবার একটি গোলাপ ফুটলো।
মেলা
আমাকে আর টানছিল না। যাবোনা যাবোনা করেও তবু গেলাম। কিন্তু যা ঘটলো, আমার
সহযাত্রীরা, বিশেষ করে তখনকার পত্রিকার বন্ধুরা দেখি অনেকেই আমার সঙ্গে কথা বলছে
না। আমি কারণ খুঁজে পাচ্ছিনা। খুব অবাক হলাম। পরে জেনেছি মেলা পুড়ে যাওয়ার পরদিন
থেকেই তারা বিপুল আন্দোলন করেছে, অবস্থান করেছে ক্ষতিপূরণের জন্যে, আর নতুন করে
মেলা শুরুর জন্যে। আমি অবাক, যাদের কোনও ক্ষতিই হয়নি, তারা হয়ে উঠল ক্ষতিপূরণের
দাবিতে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ! বড় আন্দোলনকারি ! সবচেয়ে বড় প্রতিবাদী ! আমার কাছে এ
প্রশ্নের কোনও উত্তর মিলছে না। তাদের মনে কোনও রেখাপাত করলো না ! অথচ তারা বলছে
তাদের আন্দোলন ছাড়া এই জয় সম্ভব হতো না। আমি ভাবছি, কার জয় ! কীসের জয় ! অবশ্য
আমার ভাবনার সঙ্গে সহমত পোষণ করলেন যাঁরা তাঁদের সংখ্যা তো সামান্য। আন্দোলন তো
জরুরি ছিলই। যাদের এতবড় ক্ষতি হয়ে গেল কর্তৃপক্ষের গাফিলতির জন্যে, তার তো একটা
ক্ষতিপূরণ চাই। অবশ্য আজও মেলার ভেতর খাবার স্টলের রমরমা। আজও মেলায় আগুন জ্বালিয়ে
খাবার তৈরি হয়। তবে আগের থেকে অনেক সাবধানে। কিন্তু সেই থেকে আমার জীবন দেখার চোখ
অনেকটাই বদলে গেছে। একটা বিশ্বাস আমার মধ্যে জন্মেছে, সাহিত্যের জন্যে সবার আগে
চাই সততা। সততা ও নিবেদন ছাড়া সত্যিকারের সাহিত্যকর্মী হওয়া যায় বলে আমার মনে হয়
না।
সময়
এবং সমাজ সম্পর্কে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াগুলো তাই ব্যক্তিভেদে পাল্টে পাল্টে যেতে
পারে। বদলে যেতে পারে প্রতিবাদের ধরণ, নীতি ও আদর্শ। হয়তো আমিই ভুল। কিন্তু আমার
ভেতরের আমিটা শুধু দহন বোঝে। সে পুড়ছে নিজের আগুনে। আজও পারি না। যেখানে দেখি
সততার অভাব রয়েছে, সেখান থেকে সরে আসতেই মন সায় দেয়। আজও মুখ ফুটে বলতে পারিনা এই
করেছি, এই করলাম। বা এই এটা আমি করতে চাই। কিছু করার ক্ষমতা নেই আমার, এই বিশাল
সমুদ্রে একবিন্দু চোখের জল নিক্ষেপ ছাড়া। সেই সঙ্গে এটাও বলি, প্রতিক্রিয়া জানানোর
ভাষাটাও আমার জানা নেই সেভাবে। সঠিক সময়ও বুঝে উঠতে পারি না। প্রিয়জনের মৃত্যু
সহযাত্রী হতেও কষ্ট হয় খুব। শুধু একাকী নির্জনতার মধ্যে এক দহন। আমার বোধ আমাকে
পোড়ায়। পোড়াতেই থাকে।
বিষয়টা
এলো করোনাকালের সামাজিক অবস্থা, মানুষের ভূমিকা, ব্যক্তিগত ভূমিকা ইত্যাদি নিয়ে
দুচার কথা বলতে বসে। এবারও বইমেলার সময় অর্থাৎ জানুয়ারির শেষ থেকেই করোনার কথা
মানুষের মুখে মুখে ফিরছিল, তবে হালকা প্রচারের মতো। নিজেদের সাবধানতা নিয়ে কথা
হচ্ছিল। রুণার কথা খুব মনে পড়ছে। কবি রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে আলোচক-গল্পকার-অনুবাদক।
বহমুখী কর্মকাণ্ড তাঁর। সামাজিক জীবনে সে একজন নীরব বিজ্ঞান গবেষক। আমাদের বারবার
করোনার কথা বলছিল সে। ছেলে আমেরিকায়। ছেলে সচেতনতা পাঠাচ্ছে মাকে। মা সচেতনতা
দিচ্ছে আমাদের। আমরা অনেকেই আমল দিচ্ছি না। আমাদের দেশ সাবধান হতে আরও দুমাস পার
করে ফেললো। আমরা বাধ্য হলাম গৃহবন্দি হতে। সেই থেকে আমাদের জীবন, জীবিকা, চলাচল,
এমনকি মানসিকতার উপর প্রভাব ফেলতে শুরু করলো।
এই
পরিবর্তিত অবস্থাটাই আগামী পৃথিবী। একদিন হয়তো মেনে নিতে হবে সব। জানিনা কোথায়
গিয়ে দাঁড়াবো আমরা ! আমাদের জীবন নির্ভর করে সামাজিক বিভিন্নতা নিয়ে। উপার্জন এবং
কাজের পদ্ধতির উপর। কিন্তু এমন এক মারণ ভাইরাস এল, তার কাছে প্রত্যেকে সমান অসহায়।
এই অসহনীয় এবং অপ্রত্যাশিত জীবন নিয়ে কতদিন আর ঘরে বসে থাকা যায় ! মানুষ একটু একটু
করে অস্থির হয়ে উঠছে। তার মধ্যেই এল প্রবল ঘূর্ণিঝড়। কলকাতা শহর সহ রাজ্যের কয়েকটি
অঞ্চল বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো ভয়ানক। সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, জল,
বিদ্যুৎ, যোগাযোগ ব্যবস্থা সব। পাল্টে গেল এই অঞ্চলের মানুষের সামাজিক দূরত্ব,
শুদ্ধতা, নিরাপত্তা ইত্যাদি নিয়ে সব সাবধানতা। জীবনযাপন, স্বভাব, প্রকৃতি। যাঁরা
এর কবলে পড়েননি, তাঁদের হয়তো অবস্থাটা ঠিক বোঝানো সম্ভব নয়। খবরে দেখে বা কানে
শুনে ভয়াবহতা পুরোপুরি অনুভব করা যায় না। উড়িষ্যা ধ্বংসের কথা মনে আছে! হয়েছিল
সম্ভবত ২০০০ সালে। ওই সালেই বন্যা বিধ্বস্ত হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু অঞ্চল,
বিশেষ করে উত্তর চব্বিশ পরগনার ইছামতী কূলবর্তী এলাকা। ২০০৯-এ আয়লায় ধ্বংস হয়েছিল
একইভাবে উত্তর ও দক্ষিণের একই অঞ্চল। যাকে আজও আয়লা অধ্যুষিত এলাকা বলা হয়। এবার
সঙ্গে নিল কলকাতা শহর। ১৩৩ কিমি বেগে ঝড়ের গতি এবং একনাগাড়ে ভারি বৃষ্টির তোড়, এমন
অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকের জীবনেই হয়তো প্রথম। যে অভিজ্ঞতাকে আমি ১৯৯৭-এর বইমেলা
ধ্বংসের ভয়াবহতার সঙ্গে তুলনা করতে চেয়েছি। এই মুহূর্তের করোনার হাতে ঘরবন্দি
মানুষের জীবনে যে অবসাদ তার সঙ্গে জুড়ে গেল কিছু অঞ্চলের মানুষের সব হারানোর
হাহাকার। শহর কলকাতার মানুষেরও জল আলো খাদ্যের হাহাকার।
'অবসাদ'
শব্দটি এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঘরে বসে বসে মানুষ কোনও না কোনোভাবেই কমবেশি
অবসাদের শিকার হচ্ছে। আমরা তো সামাজিক জীব। প্রতিদিন ঘরের বাইরে নানারকম মানুষের
সঙ্গে মেলামেশার মধ্যে দিয়ে জীবনে নানা বৈচিত্র্যের সুযোগ পাই। দিনের শেষে নিজেকে
কিছুটা অন্যভাবে খুঁজে পাওয়া। সবাই হয়তো বুঝিয়ে বলতে পারেন না, তবে মনের মধ্যে তার
একটা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলতে থাকে। কিন্তু এভাবে ঘরে থাকতে থাকতে, মানুষের সঙ্গে
দূরত্ব বজায় রাখতে রাখতে মানুষ যখন সেই বৈচিত্র্য থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে তখন মানসিক
অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে বাধ্য। যা থেকে এখন জন্ম নিচ্ছে নানারকম মানসিক রোগের
উপসর্গ।
এ
নিয়ে বিশেষজ্ঞরা অনেক কিছু বলেছেন, বলছেনও। আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে এবং অভিজ্ঞতায়
যেটুকু মনে হচ্ছিল, প্রতিটি মানুষের কিছু কাজ চাই। প্রথমত ঘরোয়া কাজে নিজেকে জড়িয়ে
রাখা, দ্বিতীয়ত গঠনমূলক বা সৃজনশীল কোনও কাজ। কিন্তু সে কাজে একটা ছন্দ চাই, লয়
চাই, তারপর আনন্দ। আনন্দ আসে কাজকর্মের বৈচিত্র্য থেকে। প্রতিদিন একই কাজ করে
যাওয়ার মধ্যে মানুষ তেমন আনন্দ পায় না। অধিকাংশই করেন বাধ্য হয়ে। ঘরোয়া কাজেও এমন
ঘটে এবং চাকরি জীবনেও। আমরা যারা কর্মসূত্রে প্রতিরক্ষা শিল্পের অস্ত্রশস্ত্র
তৈরির সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম বা এখনও রয়েছি তাদের ব্যক্তিগত অনুভূতি যেমন, একজন
শিক্ষক, একজন ব্যাংককর্মী বা রেলের চালক, প্রত্যেকেরই অভিজ্ঞতা হয়তো কমবেশি একই।
কেউ কেউ কাজের পদ্ধতি পাল্টে বৈচিত্র্য খুঁজতে চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত
দিনের শেষে সেই এক। একঘেয়েমি একটা থেকেই যায়।
আমরা
সৃষ্টিশীল কাজের ক্ষেত্রে যদি আসি সেখানে কখনও কখনও চারপাশের কোলাহল থেকে
নির্লিপ্ত থাকার কথা বলা হয়, কিন্তু লক্ষ্য করবো চারপাশের প্রভাব থেকে নিজেকে
নির্লিপ্ত করাটা খুব সহজ নয়। চাকরি জীবন কেটেছে একটা কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে ।
তখনও চাকরিটাকে চারদেয়ালের মধ্যে বন্দিজীবন বলে মনে হচ্ছিল, এইধরনের চাকরিতে
অনেকেরই এমনটা হয়। কারণ যেখানে একবার ভেতরে ঢোকার পর দিনের শেষেই বাইরে বেরোনোর
অনুমতি মেলে। তার আগে সহজে নয়। এই কারণে এটাকে অনেকের জেলখানার জীবন মনে হয়। এই
বন্দিদশা থেকে মুক্তির জন্যে সময়কে ব্যবহার করতে শিখতে হয়। আমি কাজের ফাঁকে ফাঁকে অবসর
সময়কে নিজের সৃষ্টিশীল কাজে ব্যবহারের চেষ্টা করলাম। অস্ত্রশস্ত্রের সঙ্গে
সম্পর্কটা গভীর হল না, কিন্তু তৈরি করলাম লোহালক্কড়, যন্ত্রপাতির সঙ্গে থেকেও তার
বাইরের নিজস্ব একটা ছন্দ। ভাবনার ছন্দ। অনেকেই অবাক হয়েছেন। বিস্ময়কর মনে করেছেন,
কিন্তু আমি মনের আনন্দে গোলাবারুদের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছিলাম শব্দের সংসার।
পাশাপাশি এক একজন শ্রমিককে দেখতে চেয়েছি ব্যক্তিগত শিক্ষা, মূল্যবোধ ও
মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টি দিয়ে। জীবনের সেই চল্লিশটা বছর, দিনের প্রায় দশঘণ্টা করে কেটে
গেল চারদেওয়ালের মধ্যে। নিজের তাগিদে বন্দিজীবন থেকে আনন্দ খোঁজার জেদ নিয়ে।
বন্দিদশায় মানুষের প্রকৃতি, অন্তর ও বাইরের দুটি ভিন্ন রূপ, ভেদাভেদ, চিনতে
সাহায্য করেছে খুব কাছে থেকে। এখন ভাবতে অবাক লাগে দমবন্ধ সেই পরিবেশকে আমি
ব্যবহার করতে পেরেছি এবং কিছুটা হলেও আমি বন্দিদশা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে
পেরেছি। তবে যত সহজে আজ বলা যাচ্ছে, তখন সেটা গড়ে তুলতে লেগে গেছে প্রায় দশ বছর।
এখন
অবসরকালেও চেষ্টা করেছি সময়কে একটা নির্দিষ্ট ছন্দে ব্যবহার করতে। বেশ চলছিল।
করোনা সংকটের শুরুতে অর্থাৎ লকডাউন যখন শুরু হয়, তার মধ্যেও মনে হয়েছিল বেশ কেটে
যাবে হয়তো ঘরের কাজের ফাঁকে ফাঁকে লেখালেখি নিয়ে, পড়াশোনা নিয়ে। কিন্তু বন্দিজীবন
যত দীর্ঘ হয়, অনিশ্চয়তা বাড়তেই থাকে। এটা এমন এক সংক্রমণ, যার সম্বন্ধে আমাদের
পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। থমকে যাচ্ছে জীবনের
বাকি সব চলমানতা। ডাক্তার-বৈদ্য, প্রয়োজনীয় যোগাযোগ, ওষুধপত্তর ইত্যাদির নিয়মিত
জোগানের অভাব। বেড়েই চলেছে। ফলে কোথায় মুক্তি ! এ বিষয়ে একটু আধটু নজর রাখতে
হচ্ছে। জানার আগ্রহ বাড়ছে। জানতে হবে, নিজেকে কিছুটা আপডেট করাও জরুরি। জানতে
গিয়েই যত বিপত্তি। একদিকে মৃত্যুমিছিল, তার উপর আমাদের সমাজব্যবস্থা ও সংবাদ
মাধ্যমের ভূমিকা। দেখছি, এরা সমাজগঠনের তো কোনও দায়ই আর বহন করে না। এরা মূলত যা
করে তাতে মানুষ যতটা জানবে বুঝবে, তারচেয়ে বেশি বিভ্রান্ত এবং অসুস্থ হতে থাকবে।
আমার এমনটাই মনে হতে লাগলো। এর সঙ্গে নিত্য চলছে রাজনৈতিক তরজা। এ নিয়ে বিস্তারিত
না বললেও চলবে। আজকের পাঠক আমার থেকে অনেক বেশি এগিয়ে। আমি যতটা পেরেছি চেষ্টা
করেছি নিজের মতো করে নিজের ভাবনার সঙ্গে বিচার এবং বিশ্লেষণ দিয়ে। ডুবে থাকতে
চেয়েছি নিজের কাজে নিজের মতো করে। কিন্তু সেটা কতদিন সম্ভব, আর কতদিন সম্ভব !
দেখা
যাচ্ছে গত দুমাসে অতিমারীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে মানসিক রোগের সমস্যা। সামাজিক
দূরত্ব মেনে ঘরে থাকতে থাকতে বিভিন্ন বয়সের মানুষের মধ্যে বিচিত্র সব আচরণের জন্ম
নিচ্ছে। বড়দের অবস্থাই যেখানে বেহাল, শিশুরাও শিকার হচ্ছে নানাভাবে। চিকিৎসকরা
বলছেন, আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, নানারকম পরামর্শ দিচ্ছেন। বাইরে থেকে অনেক শিশুকে
হাসিখুশি মনে হলেও ভেতরে ভেতরে হয়ে উঠছে অনেকেই অবাধ্য। আবার অনেকেই হয়ে যাচ্ছে
খুব চুপচাপ। এ জাতীয় লক্ষণ খুব উদ্বেগের। কিন্তু আমরা ক'জন পেরে উঠছি তাঁদের
পরামর্শ মতো সন্তানের সঙ্গে বন্ধুসুলভ হয়ে উঠতে ! আমরা বাড়ির ছাদে বা বাড়ির মধ্যে
বাগানে প্রকৃতির সঙ্গে শিশুদের নিয়ে কতটুকু সময় দিতে পারছি ! কতটা তাদের ইচ্ছেকে
প্রাধান্য দিয়ে আপন হয়ে উঠতে পারছি ! বিষয়টা যথেষ্ট ভাববার। আমরা নিজেরাও আক্রান্ত
যেখানে।
আরও
কয়েকটি বিষয় খুব নাড়া দিচ্ছে ভেতরে ভেতরে। যেমন দারিদ্র্য। সঙ্গে কর্মহীনতা। এখনই
লকডাউনের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে তাই প্রশ্ন উঠছে। মানুষ যদি খেতে না পায়, ক্রমশ ঘরে
যদি অর্থের জোগান কমে আসে, যদি কর্মহীন হয়ে পড়ে, তাহলে কীসের লকডাউন ! এই ব্যবস্থা
কতদিন চলতে পারে ! এর একটা বিকল্প তো চাই ! কিন্তু কী হতে পারে এই বিকল্প ! এই
নিয়ে মতামত দেওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। অনেকেই অনেক সম্ভাবনার কথা বলছেন। কিন্তু এই
পরিস্থিতিতে সমাজে যা ঘটছে তার একমাত্র শব্দটি হল অনিশ্চয়তা। তার সঙ্গে তৈরি হচ্ছে
মানুষে মানুষে ভেদাভেদ। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, –"ধনের ধর্মই অসাম্য"।
তার কোনও অন্যথা দেখি না। যেখানে পঙ্গু হতে বসেছে দেশের অর্থনীতি তবু বিত্তজন জেগে
আছে নিজস্ব ধনের সন্ধানে। চারদিকে একটা চাপা হাহাকার। মানুষ পেটের টানে বেরিয়ে
পড়ছে ঘর ছেড়ে। সচেতনতা, দূরদৃষ্টি এবং পরিকল্পনার অভাব অসহনীয় হয়ে উঠছে। প্রতিদিন
ডেকে আনা হচ্ছে অকাল দুর্ভিক্ষ।
একজন
জিন-বিজ্ঞানী প্রশ্ন তুলছেন–কোভিড-১৯-এর অ্যান্টিবডি মিললেই কি তিনি বাইরের জগতে
বা কাজের জায়গায় প্রবেশের পক্ষে নিরাপদ হয়ে উঠবেন ! তিনি বলছেন– "অ্যান্টিবডি
মানেই ইমিউনিটি নয়। ইমিউনিটির চিত্র স্পষ্ট না হলে ধরা যাবে না নভেলকরোনার
'রিপ্রোডাকশন নম্বর'-এর বাড়া কমা। ফলে কতজন মানুষ নতুন করে আক্রান্ত হতে পারেন
কোনও দিনই তার হিসেব মিলবে না–লাল-কমলা-সবুজের লুকোচুরি খেলাও চলতে থাকবে নিরন্তর
!" ( মাননীয় মৃন্ময় চন্দ )। ক্রমশ আক্রান্তের সংখ্যা যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে
বিষয়টা তো আর সহজ করে ভাবার নয়। ভাবতে হবে যথেষ্ট মানবিক হয়েই। আমরা কজন
সত্যিকারের মানবিক !
সমস্যা প্রতিদিনই নতুন রূপ নিচ্ছে। এর মধ্যে আর একটি হল, অনেকেই তাঁদের বাড়ির পরিচারিকাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছেন। অনেক পরিচারিকাই যানবাহনের অভাবে বাড়িতে আটকা পড়ে আছেন। তারা মার্চ মাস থেকে মাসমাইনের টাকা নিতে আসতে পারেননি। এখন কথা হচ্ছে, লকডাউনের পর যান চলাচল যখন স্বাভাবিক হবে তাদের সবার কাজ থাকবে তো ! এখন এই অবস্থার মধ্যে তাদের সংসার চলছে তো ! কে জোগান দিচ্ছে তাদের পেটের ভাত ! কোথা থেকে আসছে তাদের তেল নুন চাল ডাল ! সরকার সব ঠিক ঠিক তদারকি করছে তো ! রয়েছে অনেক ছোট ছোট কলকারখানা। যার সঙ্গেও লক্ষ লক্ষ মানুষের রুটি-রুজি জড়িয়ে। অনেক মালিকের পক্ষে কাজ বন্ধ থাকলে শ্রমিকদের মাইনে বা মজুরি দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে, কারণ উৎপাদনের সঙ্গে তাদের উপার্জন জড়িয়ে। মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রেও বলার কথা হল তাদের শ্রমিকদের অবস্থাটা কিন্তু খুব সুখকর নয়। লকডাউন উঠে গেলে তাদের শ্রমিকরাও সবাই আবার কাজ ফিরে পাবে তো ! সারা দেশে শ্রমিকদের নিয়ে ঠিকাদারি ব্যবস্থার খুব রমরমা। আজ 'পরিযায়ী শ্রমিক' শব্দটি চালু করে দেওয়া হল। এর একটা বড় অংশই বিভিন্ন রাজ্যে কাজ পায় ঠিকাদারদের মাধ্যমে। আজ ঘরে ফিরে আসার আকুতি, আবার পরে কাজ ফিরে পাওয়ার মধ্যে প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে। এভাবে গড়ে উঠছে সরকারি-বেসরকারি সবরকম সংস্থাতেই প্রতিদিনের নানা উদ্বেগ, অনির্ভরতা। গত মার্চ মাসে দেশের বেকারত্বের হার ছিল ৮.৭%, এপ্রিলের শুরুতে ২৬%, আর এখন ! ভাবলেই আতঙ্ক বাড়তে থাকে। এ থেকে মুক্তির পথ কোথায় !
ভিন
রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকদের এ হল একপেশে একটি মানচিত্র। আসলে তাদের কথা সেভাবে
কেউ কখনও ভাবেনি। অর্থাৎ সামনে আসেনি। আইটি সেক্টরের কথা বলে বলে আমরা যতটুকু
রাজনৈতিক বিতর্কে আমাদের মূল্যবান সময় ব্যয় করেছি, আজ যখন সাধারণ খেটে খাওয়া লক্ষ
লক্ষ শ্রমিকের দূরবস্থা চোখের সামনে উঠে আসছে তখন আমরা দেখছি বিষয়টা কী ভয়াবহ ! এই
সংকটের মধ্যেই তাদের ঘরে ফেরানোর তাড়া। কেন ! যদি ফেরাতেই হতো, তাহলে লকডাউনের
শুরুতেই হল না কেন ! বা যারা যে রাজ্যে কাজ করছিল সেই রাজ্যের সরকার তাদের দায়িত্ব
নিচ্ছে না কেন ! বা কেন্দ্রীয় সরকার ! প্রশ্নগুলো জাগে, কিন্তু উত্তর মেলে না।
যারা পরিবার নিয়ে বিভিন্ন রাজ্যে রুটি-রুজির জন্যে নিরলস শ্রম দিয়েছেন, তাদের
স্ত্রীদের অনেকেই আশেপাশের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতেন। সেইসব শ্রমিক ও তাদের
পরিবার নিজের নিজের রাজ্যে ফিরে আসার পর তাদের আবার কাজ মিলবে তো ! নিজের রাজ্যে
কাজের জোগান ছিল না বলেই তো কারও মাধ্যমে তারা ভিন্ রাজ্যে কাজের সন্ধানে গিয়েছিল
!
করোনার
কারণে যেভাবে ধাক্কা খেল দেশের অর্থনীতি, তাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হল দেশের সাধারণ
খেটে খাওয়া এইসব শ্রমিক কর্মচারী, সাধারণ মানুষ। একটি মর্মস্পর্শী তথ্য নজরে এল এ
সময়ে, দেখা যাচ্ছে গত বছর সারা পৃথিবীতে শুধু ৫০ লক্ষ শিশুই মারা যায় খাদ্যের অভাবে।
এ নিয়ে তেমন কোনও মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু করোনা ছড়িয়ে পড়লে
লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হতে পারে এই আশঙ্কা সারা বিশ্বে সংকট সৃষ্টি করেছে। কারণ
কী এর ! দরিদ্ররা মারা গেলে কারও কিছু যায় আসে না ! আর আজ কোভিড-১৯ আমাদের কাছে
বিপজ্জনক হয়ে উঠলো এই কারণে যে ভাইরাস কখনও শ্রেণী, জাত-পাত-ধর্ম-বর্ণ, ধনী-দরিদ্র
মানছে না তাই ! উচ্চবিত্তদের জন্যেই কি এত মাথাব্যথা ! সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে
তো ছেলেখেলা চলছে।
ভাবনা
আরেকটি দিক নিয়েও, তা হল শিক্ষা। যাঁরা এই ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে, তাঁদের অনেকের
ভেতর সবসময় একটা সদিচ্ছা নিশ্চয়ই কাজ করে যে কী হবে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ! শিক্ষা
বলতে এই মুহূর্তে প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি-প্রক্রিয়ার কথাই প্রধান হয়ে উঠছে। আজকাল তো
রবীন্দ্রনাথের মতো ঘরে বসে শিক্ষার কথা ভাবাই যায় না। তার উপর গৃহশিক্ষকদেরও একটা
বাধানিষেধ রয়েছে। সর্বত্র সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্যে সবাইকেই সচেতন থাকতে
হচ্ছে। এক্ষেত্রে জরুরি কথা হল, শিক্ষার প্রচলিত ধারাও পড়েছে গভীর সংকটের মধ্যে।
জানা যায়, এই মুহূর্তে আমাদের দেশে সরাসরি গোটা বিষয়টার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে প্রায়
তেইশ কোটি শিক্ষার্থী।
লকডাউন
উঠলে মানুষ প্রথম হয়তো ভাববে স্বাস্থ্যের নিরাপত্তার কথা, তারপর খাদ্যের ব্যবস্থা।
তার জন্যে জীবিকার নিশ্চয়তা। শিক্ষার গুরুত্ব তার পরে। আমাদের ধারণা বলছে, সংক্রমণ
পুরোপুরি রোধ হলে তবেই হয়তো স্বাভাবিক হবে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা। সেদিন যে কবে
আসবে তা আমাদের জানা নেই। তা যদি সম্ভব না হয় প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতিই বদলে ফেলতে
হবে। সেটা কি সম্ভব আমাদের দেশে ! কোথাও কোথাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে শুরু হয়েছে
অনলাইন শিক্ষাদান, ভিডিও পদ্ধতিতে, টিভি বা রেডিও সম্প্রচারের মাধ্যমে। কিন্তু
সর্বত্র কি এভাবে শিক্ষাদান সম্ভব ! প্রচুর প্রশ্ন উঠে আসছে। আমাদের ভেবে দেখতে
হবে এই ধরনের উচ্চ প্রাযুক্তিক ব্যবস্থা বিশ্বের উন্নত দেশগুলিতেই বা কতটা কার্যকর
হয়েছে !
দেশের যে পরিকাঠামো, অধিকাংশ মানুষের যে অর্থনৈতিক অবস্থান, জীবনযাপন, তাতে সাধারণ স্কুলশিক্ষায় আন্তর্জালিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করা বোধহয় স্বপ্ন দেখার মতো। আমরা যতটুকু বুঝি দেশের অসংখ্য নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের শুধু স্কুলমুখী করে তোলার জন্যেই চালু করা হয়েছিল দুপুরের খাবার। সেই খাবারই যদি না জোটে শিক্ষার প্রতি তাদের আগ্রহ কি ধরে রাখা সম্ভব ! প্রসঙ্গত বলি গত শতকের ষাট-সত্তরের দশকেও প্রাথমিক স্তরে স্কুলে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা চালু ছিল। উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রেও দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন সংকট। কী হবে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক প্রবেশিকা পরীক্ষার ! বোর্ডের অসমাপ্ত পরীক্ষাগুলো নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। ভাবাই যাচ্ছে না শেষ পর্যন্ত কোথায় চলেছি আমরা ! আমফানের ধাক্কা নিয়ে এখনও বিধ্বস্ত এলাকার মানুষ যে আতঙ্কে রয়েছেন, তা সহজে স্বাভাবিক হওয়ার নয়। ভয়ানক ক্ষতি। বহু অঞ্চল এখনও জলমগ্ন। রাস্তা ভেঙেছে, যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। বিদ্যুৎ নেই। গৃহহীন পরিবারগুলো ত্রাণ শিবিরে। কোথাও খোলা আকাশের নীচে জীবন কাটছে। অসংখ্য শিশু পেট পুরে খাবার পাচ্ছে না। পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। অনেক জায়গায় টিউবওয়েল জলের নীচে ডুবে আছে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থার আর্সেনিক মুক্ত জলের সরবরাহও এই মুহূর্তে স্বাভাবিক নয়। সব্জি, ধান, বিস্তীর্ন চাষের জমি ভরা ফসল নিয়ে জলের তলে। আর কত বলবো ! একে করোনা, তার উপর আমফানের ছোবল। এই অবস্থায় সামাজিক দূরত্বের বাঁধন শিথিল হচ্ছে প্রতিদিন। বাজারঘাট খুলছে। যান চলাচল বাড়ছে। অফিস কাছারি খুলছে। কিন্তু সংক্রমণের হার কম হচ্ছে না। এ কোথায় চলেছি আমরা ! সময় যে বড় ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। কিন্তু সে কান্না সবাই শুনতে পাচ্ছে কি ! এপথের শেষ কোথায়, বাঁচারই বা পথ কোথায় ! যদি বেঁচে থাকি তাহলে হয়তো দেখবো এক নতুন পৃথিবী। যা অভাবনীয় এবং অপ্রত্যাশিত।
ভালো লাগল বেশ। ব্যক্তিক অনুভূতি উদাহরণসহ, নিজস্ব সিদ্ধান্ত-- সবাই প্রতিকার প্রতিবাদ পন্থা জানে না। কেউ কেউ মর্মে মরে, হৃদয়ে পোড়ে, নীরব চোখের জলে ভাসে। নিজেকে এইভাবে প্রতিষ্ঠা দিয়েও শেষাবধি কিন্তু লেখা ক্রমেই সার্বিকের দিকে গ্যাছে। সেখানেও ব্যক্তিক দেখা ও ভাবনার মাধ্যমেই উঠে এসেছে সমাজ-রাজ-অর্থনীতির কথা। কয়েকটা আপাতছোট দিক উন্মোচিত হয়েছে। সে বাড়ির কাজ-করার মহিলাটি থেকে ছোটো-খাটো সংস্থায় কাজ-করা মানুষ, মাঝারি শিল্পের শ্রমিক, প্রবাসী শ্রমিকদের কথা, এবং লকডাউনজনিত কর্মহারানো ও অর্থনীতির কথা। এসেছে ব্যক্তিজীবনের মনোরোগের কথা, যা ভীষণই গুরুত্বপূর্ণ। বোঝা গেল একজন শিল্পী শুধুই ব্যক্তিকেন্দ্রিক থাকতে পারেন না। তাঁকে চারপাশ খুবই আক্রমণ করে নানভাবে। কারণ, শিল্পীসত্তার প্রথম শর্তটাই হচ্ছে মানবিক, মানবিকতা, মানুষ। ভালো লাগল চিত্ত। ভালো থেকো।
ReplyDeleteএকজন প্রখ্যাত কবি , গদ্যকার , প্রাবন্ধিক শ্রী চিত্তরঞ্জন হীরাকে অন্যভাবে দেখার সুযোগ পেয়ে ধন্য হলাম । যিনি নির্মোহ আত্মপরিচয় নিয়ে মানুষের কথা লিখলেন , সততা আর সহজতা মিলিয়ে । মানুষের সাম্প্রতিক দুঃখ, কষ্ট ,অসহায়তা আর অনিশ্চয়তার মুহূর্তে কেবলমাত্র 'একজন মানুষ' হয়ে তার অনুভব ভাগ করলেন সাহিত্যের দরবারে ।
ReplyDeletePost a Comment