কবি-গদ্যকার হিসেবেই তাঁর জনপ্রিয়তা। পেশায় স্কুল শিক্ষক হলেও ভালোবাসেন সাহিত্যের কাজে নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়োজিত করে দিতে। কবিতাই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান আর সঞ্চরণ-ভূমি।

প্রিয় মুখ, মুখবন্ধনীতে ঢাকা

রাণা রায়চৌধুরী 


একটা রোগ একটা মহামারী ঝড়ের মতো ধেয়ে আসতেই পারে, মানুষের জীবনে- জগতে সমাজে- সারা পৃথিবীতে। মানুষের এই দুর্ভোগ জগত সৃষ্টির শুরু থেকেই হয়েছে। এবং মানুষ তাকে অতিক্রম করে আবার এগিয়েছে সভ্যতার দিকে, আধুনিকতার পথে। আমরা বইয়ে পড়েছি, বড়দের মুখে শুনেছি, বিভিন্ন মহামারীর কথা, কিন্তু তাকে অনুভব করতে পারিনি, বুঝতে পারিনি তার ভয়াবহতা, তার নিষ্ঠুরতা কতদূর। 

সামান্য একটা জীবানু যাকে বিজ্ঞানীরা বলেন ‘ভাইরাস’ তা যে মানুষের বুদ্ধিকে তার শিক্ষিত মস্তিষ্ককে তার আধুনিকতাকে এমন তছনছ করে দেবে, তা আমরা যারা পূর্বের মহামারীগুলোকে প্রত্যক্ষ করিনি তারা এটা ভাবতেই পারিনি। ভাইরাস মানুষের জোটবদ্ধ সমাজকে ব্যঙ্গ করেছে। তাকে একা করে দিয়েছে। এ এই প্রজন্মের মানুষ বা এই সময়ের শিক্ষিত প্রযুক্তিতে উন্নত মানুষ, কল্পনাতেও ভাবেনি। মানুষের সব অহং সব দর্প ভেঙে চূড়মার হয়ে গেছে।

আমাদের একে অপরকে জড়িয়ে থাকার ভালোবাসার অভ্যেসে কোন এক অদৃশ্য ‘ভাইরাস’ নামক দানব এসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আমাদের আধুনিক শিক্ষিত যে প্রতিদিনের রুটিন তা ভাইরাস-আগুনে পুড়ে ছাড়খাড়। মানুষের মনে ভয়, আতঙ্ক মানুষের মনে অবিশ্বাস – ভাইরাস আক্রান্তকে সন্দেহ, তাকে একলা করে দেওয়া, এইসবই মানবিকতার এবং আধুনিকতার উল্টো দিকের স্রোত। আবার এও ঠিক মানুষ এর থেকে একদিন বেরিয়ে আসবে। নতুন সকাল আসার মতো। ব্রেখটের নাটকে আমরা সত্তরের দশকে দেখতাম না, নতুন সূর্যোদয়, নতুন বাতাসের আশ্বাস ঠিক সেইরকম। 

ভাইরাস কি মানুষ তৈরি করল, করল কি সৃষ্টি? তাতো বটেই, মানুষ তার জান্তে বা অজান্তে এই মারণ রোগকে কাছে ডেকে এনেছে। ফলত মানুষের গৃহবন্দী দশা, একাকীত্ব, এবং বেঁধে বেঁধে থাকা থেকে দূরে থাকা। খবরের কাগজের ভাষায় যাকে ‘সোশাল ডিসস্টেন্স’ বলে। ভাবা যায়! মানুষ একে অপরের কাছে আসতে চেয়েছিল, একে অপরকে ভালোবাসায় আদরে স্নেহে জড়িয়ে থাকবে ভেবেছিল। তার বদলে একটা পুচকে জীবাণু মানুষকে - একে অপরের কাছে থাকতে দিল না, সে মানুষের দেহে বংশ বৃদ্ধি করতে করতে, তাক কোণঠাসা করে দিল। 

মানুষ বন্ধু বান্ধব সখা প্রেমিক প্রেমিকা নেতা সহকর্মী থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হল, মৃত্যু যন্ত্রণা বা রোগ যন্ত্রণার ভয়ে।

প্রথম প্রথম আমি সত্যিই খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম। রাস্তায় বেরোলেই খুব শ্বাসকষ্ট হতো। এখন সেই টেনশনটা আর অতো আমাকে বেকায়দায় ফেলে না, সয়ে গেছে। কিন্তু প্রথম প্রথম মনে হতো একটা যুদ্ধ চলছে, যে কোনো মুহূর্তে মাথায় শত্রুপক্ষের বোমা এসে পড়বে। এইরকম একটা ভয়ঙ্কর ভয় আমার ভিতরে কাজ করত। এইবার সত্যিই টের পেতে শুরু করলাম – আমি বা আমরা মহামারীর ওই ভয়ঙ্কর গুরুত্ব। ভাইরাসকে মনে মনে আমরা সবাই শ্রদ্ধার আসনে না বসালেও তাকে আমরা সম্ভ্রম করতে শুরু করলাম। মুখে মাস্ক, পকেটে একটা রঙিন বা সাদা লিকুইড, যাকে মিডিয়া স্যানিটাইজার বলছে। জীবন দু’তিন মাসে পাল্টে গেল হঠাৎ। 

রাস্তায় বেরোলে যেসব মুখগুলো দেখে বাঁচার আশ্বাস পেতাম, সেগুলো আর দেখতে পেলাম না। সব মুখ, সব প্রিয় মুখ মাস্কে ঢাকা। এমনকি যে সব সুন্দরীকে দেখে দিনটাই ভালো হয়ে যেতো, মনে হতো – তরুণীদের এইসব সুন্দর মুখ দেখতে দেখতে - একদিন আমিও চাঁদে যেতে পারবো। সেইসব প্রেরণাদাত্রী সুন্দর নরম মুখগুলোও মাস্কে ঢাকা। এ কেমন পৃথিবীতে এসে পড়লাম! বিষণ্ণতা আমাদের সবাইকে কোণঠাসা করে দিতে লাগল ক্রমশ।

প্রিয় মুখ ম্লান না কি হাসিখুশি না কি দুঃখে ভরা তা আর বুঝতে পারি না আমরা।

মানুষকে অন্ধকারে, ঘোর অন্ধকারে আমরা কিভাবে চিনি? তার কণ্ঠস্বর দিয়ে। আমরা বুঝতে পারি গলা শুনে, যে বাদল কথা বলছে বা আমাদের পিসতুতো দিদি মান্তুদি কথা বলছে। কিন্তু আলোয় বা দিনের আলোয় আমরা মুখ দেখে মুখশ্রী চিনতে পারি। কিন্তু হায়, সেই মুখ এখন বিপদ আটকাতে রং-বেরঙের ‘মুখবন্ধনী’তে ঢাকা। যে মুখবন্ধনীতে শুধু ভাইরাস নয়, আতঙ্ক মনখারাপ বিচ্ছিন্নতার উদ্বেগ ইত্যাদি লেগে আছে বা আটকে গেছে। 


                                    ***   ***   ***   ***   *** 

ফেসবুকে তরুণ কবি নীলাঞ্জন সাহা একটা পোস্ট দিয়েছিলেন। করোনার এই বিপদ বাংলার এক প্রয়াত কবি টের পেয়েছিলেন অনেক বছর আগে, এই পোস্ট তারই প্রমাণ। কবিরা সত্যদ্রষ্টা এবং তাঁরা যে ভবিষ্যৎ দেখতে পান এই কবিতা বা এই পোস্ট তার প্রমাণ। 

নীলাঞ্জন সাহার পোস্ট -

“করোনাকাল নিয়ে শক্তি (কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়) কিছু পঙক্তি বহু আগেই লিখে গেছেন মনে হয়, এই যেমন –

 

      ১) ‘চুম্বন করিনি আগে, ভুল হয়ে গ্যাছে

          গ্রহণ করিনি আগে, ভুল হয়ে গ্যাছে।’

 

      ২) ‘একাকী যাব না, তোমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যাব 

          একাকী যাব না, অসময়ে’ 

 

         (মানে, কম্যুনিটি স্প্রেড আর কী!)

 

      ৩) লাশ তোলার জন্য আত্মীয় স্বজন কেউ আসবে না সেটাও তিনি বুঝেছিলেন, তাই লিখলেন,

 

         ‘মৃত্যুর পরেও যেন হেঁটে যেতে পারি’ ...” 

 ***   ***   ***   ***   ***


তাহলে আমরা সবাই বুঝতে পারছি বা টের পাচ্ছি, যার পূর্ব অভিজ্ঞতা আমাদের কারোরই ছিল না, যে এই মহামারীর সময়ে আমরা আমাদের প্রেমিকাকে বা নিজস্ব নারীকে চুম্বন পর্যন্ত করতে পারবো না, কী ভয়ঙ্কর ও দমবন্ধ বা মাস্কবন্ধ আমাদের বর্তমান জীবন ও যাপন! 

যদি জানতাম তাহলে তো আমরা এই করোনা-সময়ের যে অনির্দিষ্ট ও দীর্ঘ সময়, সেই সময়ের সব চুম্বনটুকু সেরে রাখতাম। শুধু প্রেমিকা কেন আমাদের স্নেহের মায়ার যে শিশু তাকেও পর্যন্ত আমরা কোলে তুলে স্নেহচুম্বন দিতে পারছি না। এমনকি বিদেশি যে ‘ফ্লাইং কিস’ তা পর্যন্ত আমরা দিতে ভয় পাচ্ছি, বা সেই ফ্লাইং কিস দিলেও, দেওয়ার আগে বা চুম্বন উড়ে যাওয়ার আগে আমরা তা স্যানিটাইজ করে নিচ্ছি। 

কে ভেবে ছিল, যে আমাদের ভালোবাসা, আদর, মায়া, দরদ, হাসি, কান্না এই সবকিছুকেই এই ভয়ঙ্কর সময়ে - কেমিকেলে চুবিয়ে - তারপর তার প্রয়োগ করতে হবে! সারা পৃথিবীর মানুষ এতোটা ভাবেনি। এর আগে মানুষ যথেচ্ছাচার ছিল, সে চুম্বনের বা আদরের ফিজিক্যাল প্রেমের সংযম হয়তো জানতো না, যদি জানতো, তাহলে হয়তো (সম্ভবত) এই জীবাণুর প্রবেশই ঘটতো না আমাদের মধ্যে। 

আমি যেহেতু একজন প্রাথমিক শিক্ষক, স্কুল বন্ধ, কিন্তু ছুটি - আমরা শিক্ষকেরা সকলেই সম্ভবত এই ছুটিকে ছুটির আনন্দে ফেলতে পারছি না। বাড়িতে বসে মাঝেমাঝেই বাচ্চারগুলোর মুখগুলো মনে পড়ে। বহুদিন দেখিনি ওদের, নানারকম চিন্তা ওদের নিয়ে মাথায় ঘোরে। আমার স্কুলের এইসব শিশুরা বেশিরভাগই খুব গরীব, ওদের মাস্ক কেনারও আর্থিক সামর্থ্য নেই। স্যোশাল ডিসস্টেন্স বোধহয় ওদের জীবনে নেই। ওরা বাধ্যত ‘স্যোশাল ডিসস্টেন্স’কে ডাস্টবিনে ফেলে একসঙ্গে জড়িয়ে-পেঁচিয়ে আছে। 

মানুষকে এই ভাইরাস, এই প্রতিকূলতা নিয়েই বাঁচতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে। যুগ যুগ ধরে মানুষ এইভাবেই বেঁচে এসেছে। আমাদেরও পূর্ব-পুরুষের পূর্ব-নারীর থেকে লড়াইয়ের শিক্ষা নিয়ে - এই জীবাণু এই আতঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।



Post a Comment from facebook

2 Comments

  1. খুব ভালো লেখা। একেবারে কবির গদ্য। মরমী এবং অনুভবী। কবিকে অশেষ ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  2. ভালো লাগল রানা। বেশ জমিয়ে লিখেছ। ভালো থেকো।

    ReplyDelete

Post a Comment

Previous Post Next Post