পেশা হিসেবে ‘গৃহ শিক্ষকতা’-কে বেছে নিয়েছেন। রসায়ন-বিদ্যায় পারদর্শী। ছাত্রমহলে প্রিয় নাম, তাঁর ভালোবাসার কারণে। বিজ্ঞান-বিষয়ক পত্রিকা সম্পাদনার কাজও করেন।

লকডাউন : শিবহীন শিবের গাজন

দেবজ্যোতি বিশ্বাস

 

অনেক দিন আগের কথা। অনেক দিন মানে, একটা মানুষের জীবনের তুলনায় অনেক দিন। আমাদের বাড়িতে নানান কারণে পারিবারিক গোলযোগ লেগেই থাকত। সেবারও কোনো একটা ঘটনাকে উপলক্ষ করে বিবাদের জায়গাগুলো আবারও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এমনকী রান্নাবান্না পর্যন্ত বন্ধ হওয়ার জোগাড়। এমন সময়ে আমার বাবা গুরুতর ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এমনিতে বাবা খুব যে সুস্থ থাকতেন এমন নয়, কিন্তু সেবারের অসুস্থতাটা একটু বাড়াবাড়ি রকমেরই হল। বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করতে হবে। হতে পারে, পারিবারিক সমস্যার কোনো আঁচ এর মধ্যে ছিল, অগত্যা আমাকে বন্ধুদের শরণাপন্ন হতে হল, চিকিৎসার ব্যবস্থা হল। বাবার শারীরিক অবস্থার এই অবনতির সূত্রে আমাদের পারিবারিক জীবনে যে অশান্তির পরিবেশ তৈরি হয়েছিল তাতে কিছুটা শান্তির প্রলেপ পড়ল। সব কিছু দেখেশুনে আমার এক বন্ধু মন্তব্য করল, “ঠিক যেন আশাপূর্ণা দেবীর উপন্যাসের মতো— একটা বড়ো বিপর্যয় এসে ছোট ছোট সমস্যাগুলো ঘুরিয়ে নিয়ে গেল”।

আজ কোভিড-১৯ এবং তৎপরবর্তী লকডাউন প্রসঙ্গে লিখতে বসে ওই বন্ধুর কথাটিই প্রথমে মনে পড়ছে। আর সাথে সাথেই, এই উপলব্ধিটুকুও হচ্ছে যে, বিগত তিরিশ বছরে আমরা সেই ভাবনার থেকে বহু দূরে সরে গেছি। বড়ো বিপর্যয় আজ আর আমাদের মনের সংকীর্ণতাকে দূর করে এক জায়গায় আনতে পারে না। আমাদের মনের ক্ষুদ্রতা, স্বার্থবুদ্ধিকে দূরে সরিয়ে রাখতে শেখায় না। বরং পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে কেমন ভাবে নিজের কাজ গুছিয়ে করতে হবে তারই হিসেব কষতে বসায়। এমন মানুষ যে আগে ছিল না তা তো নয়, ছিল, অবশ্যই ছিল, আর তারা মূলত সমাজের চোখে ঘৃণ্য বলেই পরিচিত ছিল। কিন্তু আজ তাঁরাই সমাজের, দেশের মাথা। লক্ষ কোটি টাকার নিউজ প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় খরচ হয় তাঁদের বন্দনা গানে। কতশত ভক্তবৃন্দ, বাবু যত বলে পারিষদদলে বলে তার শতগুণ— এই আপ্তবাক্যকে স্মরণ করায়। কী দুর্ভাগা এই দেশ! কী দুর্ভাগা এখানকার সাধারণ মানুষ!

বাইশে মার্চ। জনতা কারফিউ-এর শেষে আমার প্রিয় একজন মাস্টারমশায় ফেসবুকে লিখলেন, আমরা সকলে মিলে এক হতে পেরেছি, এই একতাই করোনার বিরুদ্ধে আমাদের জয় সুনিশ্চিত করবে। কথাটা ঠিক আক্ষরিক অর্থে এমন না হলেও ভাবগত ভাবে খানিকটা এমনই। আমি কমেন্ট বক্সে কিঞ্চিৎ সন্দেহ প্রকাশ করাতে তিনি আহত হয়ে বললেন, “আমি কি কিছু ভুল বললাম দাদা?” আমার অবস্থা তখন খানিকটা এমনই — “কেমনে বুঝায়ে কব না জানি কথা”! আসলে স্যারকে ভুল প্রমাণ করাতে আমার কোনো কৃতিত্ব নেই। আছে একরাশ লজ্জা। এ কথা আমি কীভাবে বলি, চরম দুর্দিনেও আমরা এক হতে পারিনি! এক হওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ, আমাদের সকলের স্বার্থ এক ধারায় প্রবাহিত হয় না। আর, দেশের অভিভাবকদের সেই ক্ষমতা বা ইচ্ছা আর নেই যা এই ভিন্ন খাতে বয়ে চলা স্বার্থবুদ্ধিকে আপাত-আবরণে ঢেকে রেখে সঠিক ভাবে সঠিক দিশায় পরিচালিত করে। তাই ইন্ডিয়া আর ভারত অতীতেও যেমন তফাৎ ছিল, আজও তেমনই রয়ে গেল, শুধু বাহ্যিক আবরণটা মুছে গিয়ে সে আরও সত্য, আরও স্পষ্ট, আরও নগ্ন ভাবে ফুটে উঠল।

আমি বিজ্ঞানী নই, ডাক্তার নই, নই দার্শনিক চিন্তাবিদও। কোনো বিষয়েই গভীর ভাবে ভাবার ক্ষমতা আমার নেই। আর তাই ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে বি. সি বলতে ‘বিফোর করোনা’ এবং এ. সি বলতে ‘আফটার করোনা’ ভাবা হবে কিনা সে কথা বলবার সাধ্য আমার নেই। একজন অতি সাধারণ মানুষ হিসেবে সামান্য দু-একটা কথা বলি, যার মধ্যে কোনো নতুনত্ব নেই, সকলেই জানেন।

করোনা এমন একটি ভাইরাস যার সংক্রমণ হার অত্যন্ত বেশি কিন্তু মৃত্যুহার তুলনায় অনেক কম। সংখ্যাতত্ত্বের এই বিচার সাধারণ মানুষের কাছে খুব বেশি ভরসা এনে দিতে পারে না। কারণ যে মারা যায় সংখ্যাতাত্ত্বিকদের কাছে সে হয়ত কেবল একটা সংখ্যামাত্র, কিন্তু পরিবারের কাছে সে তো আপনজন, নিজের মানুষ। তাই তার চলে যাওয়াটা পরিবারের কাছে এমন একটা শূন্যতা তৈরি করে সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে যার কোনো বিচার হয় না। তাই সাধারণ মানুষ বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজের অবস্থান অনুসারে ভীত, সন্ত্রস্ত।

করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় যেহেতু কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ আবিষ্কার করা যায়নি, তাই সাধারণ মানুষের মধ্যে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স বজায় রাখা এবং লকডাউনের মাধ্যমে তাকে সুনিশ্চিত করা— এটাই এই রোগের ছড়িয়ে পড়াকে রুখতে আপামর বিশ্বের কাছে একমাত্র হাতিয়ার। কিন্তু যে কোনো সমস্যারই যেমন বহুমাত্রিক দিক থাকে, এ ক্ষেত্রেও তার কোনো ব্যতিক্রম নেই। এদেশের উপার্জনক্ষম মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ উপার্জনের জন্য নির্ভর করে থাকে অসংগঠিত ক্ষেত্রের উপরে। লকডাউন এই মানুষের উপার্জনের উপর একটা বড়ো আঘাত তৈরি করে, তাদের পরিবার পরিজনকে চরম অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যায় এবং সামগ্রিক ভাবে দেশের অর্থনীতির ভিতটা নড়িয়ে দিয়ে যায়। লকডাউন যেহেতু মানুষের চলাচলের উপর বাধা সৃষ্টি করে তাই তা মানুষের জীবনের অন্য নানান দিকে প্রভাব ফেলে। এর প্রায় সবটাই চরিত্রগত ভাবে ক্ষতিকর। যেমন সামাজিক ক্ষেত্রে কোনো মানুষের বিপদে-আপদে অন্য মানুষকে কাছে পাওয়ার সম্ভাবনা কমে আসে। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সাধারণ রুগীর চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার হ্রাস পায়, শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক এবং সমস্ত ধরনের প্রচলিত শিক্ষাগ্রহণ পদ্ধতির পথে একটা অন্তরায় তৈরি হয়, এমন আরও কত কিছু।

সুতরাং, রাত্রি আটটায় ঘোষণা করে রাত বারোটায় লকডাউন লাগুর মধ্যে দিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী যতই নিজের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বকে সামনে আনার চেষ্টা করুন না কেন, আসলে দেশ চালানোর ক্ষেত্রে তাঁর নির্বুদ্ধিতা, অদূরদর্শিতাই পরবর্তী ঘটনাক্রমের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায়। শুধু এটুকু লিখতে পারলেও তবু একরকম হত। বিগত তিন মাসের ঘটনাবলিতে এটা প্রমাণিত, এত নৃশংস, নির্মম সরকার কখনো এদেশের শাসন-ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়নি। লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ হাজার হাজার কিলোমিটার পথ হেঁটে— হাঁটার মধ্যেই ঘরে ফেরার চেষ্টা করতে করতে যখন মৃত্যুবরণও করছেন, তখনও এই সরকারের নায়কদের সুখনিদ্রার এতটুকু ব্যাঘাত ঘটেছে বলে খবরে প্রকাশ পায়নি। এই অভুক্ত, হতদরিদ্র, অসহায় মানুষগুলোকে ট্রেনে করে বাড়ি ফেরানোর পথে তাদের কাছ থেকে কত টাকা শুষে নেওয়া যায় তা নিয়ে বিতর্কে নামতে এতটুকু রুচির অভাব হয়নি।

আমাদের দেশে চিরকাল ধনী-দরিদ্রে বৈষম্য আছে। এমন বৈষম্যের মাত্রা এখন ক্রমবর্ধমান। শোনা যায়, দেশের এক শতাংশ মানুষ দেশের তিয়াত্তর শতাংশ সম্পদের অধিকারী। দেশের সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ভিন্ন এটা হওয়া সম্ভব ছিল না। এ জন্য কেবল এই সরকারকেই দায়ী করা বৃথা। কিন্তু এই সরকার বিষয়টাকে যেমন খোলামেলা ভাবে প্রশ্রয় দিতে সাহসী হয়েছে তেমনটা অতীতে কখনো দেখা যায়নি। স্কুল কলেজে যখন ছাত্র ছিলাম, তখন ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’ বলে একটা কথা খুব শোনা যেত। যেখানে ধনীদের গায়ে আঘাত না করেও সরকারী সহায়তার মাধ্যমে গরিবের দারিদ্র্য দূর করার একটা অঙ্গীকার অন্তত রাষ্ট্রের তরফে নেওয়া হত। বর্তমান সরকারের সেই চক্ষুলজ্জাটুকু আর অবশিষ্ট নেই। গরিবদের সহায়তার অর্থ প্রদান এদের কাছে ‘ডোল আউট’, অর্থাৎ অপব্যয়। এবং ধনীদের ঋণমকুব হল ‘স্টিমুলাস প্যাকেজ’, বা উৎসাহ-দান প্রকল্প। অর্থনীতির কোনও সূত্রই প্রমাণ করে না, এর দ্বারা দেশের অর্থনীতির সামান্যতম উপকার হয়। কারণ চাহিদা এবং জোগানের ভারসাম্যের উপর যে অর্থনৈতিক কাঠামো দাঁড়িয়ে থাকে, সেখানে চাহিদার পাল্লা কমে গেলে জোগানের বৃদ্ধিরও প্রয়োজন থাকে না। আসলে এ হল তেলা মাথায় তেল দেওয়ার দর্শন।

তবে কি লকডাউনের প্রয়োজন ছিল না? অবশ্যই ছিল। দেশের আর্থিক ক্ষতি হবে জেনেও মহামারীর বৃহত্তর ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য লাকডাউন অপরিহার্য ছিল। কিন্তু সাথে সাথে এটাও মনে রাখা প্রয়োজন ছিল যে, লকডাউনকে যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত রাখা এবং ফলপ্রসূ করার জন্য জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে, এই সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের মুখে সামান্য খাবার তুলে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হবে, সামগ্রিক ভাবে দেশের মানুষের অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতে হবে। কিন্তু সরকারের অবস্থান এর সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ। তাই লকডাউন বিফল সাধারণ মানুষের কাছে। কিন্তু সরকারের কাছে নয়, কারণ, সরকারের উদ্দেশ্য কখনোই ছিল না লকডাউনের মধ্যে দিয়ে দেশের মানুষের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। বরং, তাঁরা চেয়েছিলেন এই লকডাউনকে ব্যবহার করার মধ্যে দিয়ে তাঁদের মিত্র ধনিক শ্রেণির স্বার্থ এবং সাথে সাথে দলীয় স্বার্থেও কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যা সাধারণ মানুষের হিতের বিপরীতে যায়। লকডাউন ভিন্ন এই কাজ সম্পন্ন করতে তাঁদের তীব্র বাধার সম্মুখীন হতে হত। সে কাজে তাঁরা সফল। শত দুঃখের মধ্যেও এ কথা আমাদের স্বীকার করতে হবে।

লকডাউন অন্য আরেকটি দিক থেকেও সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের সাথে শ্রমজীবী মানুষের একটা ব্যবধান তৈরি করল এ কথা স্বীকার না করলে ভুল হবে। নিশ্চিত আয় করতে পারেন এমন মধ্যবিত্ত মানুষের খাদ্যের সমস্যা না থাকায় তাঁরা করোনার ভয়ে এতখানি ভীত হয়ে পড়লেন যে তাঁদেরই সহনাগরিক হাজার হাজার মানুষকে— যাঁরা কিনা করোনায় মৃত্যু অথবা অনাহারে মৃত্যুর মধ্যে যে-কোনো একটাকে বেছে নিতে বাধ্য— তাঁদের শত্রু জ্ঞান করে বসলেন। আসলে মানুষের নিজস্ব চিন্তাভাবনা আজ এতটাই ব্যক্তি-কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে যে সমষ্টিগত চিন্তাভাবনা তাঁদের কাছ থেকে বহুদূরে সরে গেছে। কাউকে দোষারোপ করা আমার উদ্দেশ্য নয়। হয়তো সঠিক পথপ্রদর্শকের অভাবই এর কারণ।

সোশ্যাল মিডিয়াতে আজকাল আশার বাণী দেখতে পাই, ‘আমরা করব জয়’ গোছের বার্তা। অর্থাৎ, এই বিপদকে অতিক্রম করে জয়যুক্ত হয়ে আমরা একদিন অবশ্যই ঘরের বাইরে বেরোব। এই কথাটা আমার মনে আশার সঞ্চার যেমন করে, তেমন এক ধরনের হতাশারও জন্ম দেয়। আজ প্রায় তিন মাস আমরা ঘরবন্দী। এই তিন মাস বহু কাল বাদে প্রকৃতির মুখে হাসি ফিরিয়ে দিয়েছে। আকাশ আজ অনেক নির্মল। খাল বিল নদী নালার জল অনেক স্বচ্ছ। প্রাণ ভরে শ্বাস নেওয়া যায়। হারিয়ে যাওয়া অনেক জীব জন্তু পশু পাখি, যারা কিনা আমাদেরই অন্যায় দাপটে এক কোণে লুকিয়ে পড়েছিল, আজ প্রকাশ্যে আসছে। করোনাকে জয় করে যে দিন আমরা বীরের মতো বাইরে বেরোব, ঠিক সেই দিন থেকে প্রকৃতির ধ্বংস-যজ্ঞ আবার শুরু হবে। আমরা আবার নতুন করে সচেষ্ট হব, নতুন কোনো বিপদের মুখে নিজেদের ঠেলে দিতে। কথাটিতে স্ববিরোধ রয়েছে বলে মনে হলেও, এটা ঠিক যে মানুষ যেমন সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী, তেমনই সবথেকে নির্বোধ প্রাণীও বটে। তাই লকডাউন অবস্থাটাকে অনেক সময় আমার মনে হয়— “ইট ইজ দ্য বেস্ট পিরিওড অফ আওয়ার লাইফ, অ্যান্ড অ্যাট দ্য সেম টাইম, ইট ইজ দ্য ওয়ার্স্ট পিরিওড”।

সবশেষে নিজের পেশার কথায় আসি। গৃহশিক্ষকতা করি। এই সময়, যখন আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষা গ্রহণ পদ্ধতির সাধারণ পথগুলি প্রায় রুদ্ধ, তখন নতুন কিছু কিছু মাধ্যম প্রযুক্তির সাহায্যে আমাদের সামনে খুলে গেছে। প্রযুক্তিকে দোষ দেওয়ার কিছু নেই। সে ব্যক্তি নয়, সিদ্ধন্ত নেওয়ার ক্ষমতা তার নাই। তাকে যেমন চালাও, সে তেমনি চলবে। এই বৈষম্যমূলক সমাজ-ব্যবস্থায় অপেক্ষাকৃত সুবিধাভোগী শ্রেণি যেমন সমস্ত সুফলের সিংহভাগ গ্রহণ করে থাকে, এক্ষেত্রেও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। তবু এর মধ্যেও দু-একটি ভালো দিকের কথা, যা আমার নজরে এসেছে, বলি। ছোটবেলায় শুনতাম অমুক স্কুলের তমুক মাস্টারমশায় ইতিহাস খুব ভালো পড়ান। কিন্তু যেহেতু আমি ওই স্কুলের ছাত্র নই তাই তাঁর পড়া-শোনার অধিকার থেকে আমি বঞ্চিতই রয়ে যেতাম। কিন্তু এই প্রযুক্তি-ভিত্তিক পড়াশোনা এই সুযোগ আমাদের সামনে এনে দিয়েছে যে আমরা ওই রকম মাস্টারমশায়দের শিক্ষাদান প্রক্রিয়ার সাথে পরিচিত হতে পারি। এ অবশ্যই এক পাওনা।

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। ‘নায়ক’ সিনেমায় অরিন্দম মুখার্জি (অভিনয়ে উত্তম কুমার)-র সিনেমায় নামার ইচ্ছে হয়েছিল। হয়তো এর পিছনে খ্যাতি এবং অর্থের প্রলোভন ছিল। অরিন্দমের অভিনয়গুরু ছিলেন তাঁর এক দাদা, চলচ্চিত্রে যাঁর নাম ছিল শঙ্কর (অভিনয়ে সোমেন বোস)। তিনি অরিন্দমের চলচ্চিত্রে আসার বিরোধী ছিলেন। একদিন একান্ত আলোচনায় তিনি শিষ্যকে বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন— আর ধর, মঞ্চের নিচে বসে থাকা এক রাশ কালো কালো মাথাগুলো, যারা প্রতি মুহূর্তে তোকে অভিনয়ে প্রেরণা জোগায় (‘অনুপ্রেরণা’ নয়), চলচ্চিত্রে তুই সেটা পাবি কোথায়? আজ একশোরও বেশি পড়ানোর ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করার পর আমারও উপলব্ধির মধ্যে আসে কোথাও যেন একটা ফাঁক থেকে গেল। সেই কালো কালো চুলের মাথাগুলো, যাদের কারো মুখে পড়া বুঝতে পারার দীপ্তি, কারো মুখে অন্যমনস্কতার ছোঁয়া, কেউ খুব মনোযোগী, প্রতিটি শব্দকে তার খাতায় লিপিবদ্ধ করে নিতে চায়, কেউ-বা হাতের ঘড়িতে ঘন ঘন সময় দেখে মুক্তির প্রত্যাশায়— এদের ছাড়া এই পড়ানোটাই তো অসম্পূর্ণ থেকে যায়, কোনো প্রাণ আসে না— শিবকে বাদ দিয়েই শিবের পুজো চলতে থাকে!    



Post a Comment from facebook

4 Comments

  1. Tomar lekha pore khub bhalo laglo. Specially tomar lekhar shironaam

    ReplyDelete
    Replies
    1. Apni koshto kore amar lekha ta porechen er jonyo apnake anek dhonyobad.

      Delete
  2. খুব,খুব ভালো লাগল। লেখায় কতগুলো দিক যে উঠে এল! সুন্দর ঝরঝরে ও স্পষ্ট। নিজস্ব ভাবনা ও অনুভবই এই লেখার সম্পদ। ভাবনাকে বোঝাতে উদাহরণও যুক্তিযুক্ত। আর শেষটাতো মার্ভেলাস। ভালো থেকো দেবজ্যোতি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. Uma da apni amar lekha ta porechen ei amar kache anek.

      Delete

Post a Comment

Previous Post Next Post