দিল্লি নিবাসী অগ্নি রায় পেশায় সাংবাদিক। কবি-গদ্যকার-অনুবাদক-সংগ্রাহক। পেশাগত ব্যস্ততার মধ্যেও কবিতাই মূল জীবনীশক্তি। লিট্‌ল ম্যাগাজিনে লেখালিখি করেন।

করাল করোনা কথা

অগ্নি রায়


প্রতিদিন একটি মাত্র ঘাতককে কেন্দ্র করে হাজার হাজার ভিডিও ফুটেজ, নিউজ প্রিন্ট, সত্য মিথ্যার মিশেল সংবাদ, মৃত্যু, অন্নাভাব, বেকারিত্ব, মানসিক বিপর্যয়, স্থবিরতা, অবিশ্বাস, অবস্থাবন্দিত্ব গোটা বিশ্ব জুড়ে যখন একইসঙ্গে তৈরি হয়, তখন সেই অনপনেয় দুর্যোগের মধ্যে খড়কুটো আঁকড়ে বসে তাকে বিশ্লেষণ করতে চাওয়া বা তাকে সামগ্রিকভাবে দেখার চেষ্টা করাটা শুধুমাত্র অবাস্তবই নয়, কিছুটা মুর্খামিও বটে। তবুও মানুষের আশার শেষ নেই, স্বপ্নের এবং বেঁচে থাকারও জান্তব ইচ্ছাও সীমাহীন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তুলনায় এর ব্যপ্তি বেশি। যে কটি মন্বন্তর, অতিমারি, দুর্ভিক্ষ স্মরণকালের মধ্যে সভ্যতা দেখেছে, কোভিড ১৯ নামের এক অদৃশ্য অনুভাইরাসের মারণ প্রভাব তার তুলনায় বেশি। বিশ্বব্যবস্থার, উন্নয়নের, প্রগতির যে কটি নির্ণায়ক সূচক সম্ভব প্রায় সবকটির ভিতরেই বাসা বেঁধেছে করোনাভাইরাস। মেধা, শরীর, মন দিয়ে লড়াই করেও এখনও পর্যন্ত যাকে বাগে আনতে পারল না মানুষ। ভ্যাকসিন অথবা ওষুধ এখনও আবিস্কার করতে না পারা যদি তার একটা দিক হয়, তবে অন্যদিকে রক্তচোখ নিয়ে এসে দাঁড়াচ্ছে পরম এবং আদি ব্যধিক্ষমতার লড়াই, রাজনীতি, অপার দুর্নীতি, যাবতীয় ক্ষুদ্রতা।   


যেমন তিনদিন ধরে গভীর জঙ্গলের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে যে শিশুকন্যাটি মুখ থুবড়ে পড়ল এবং আর উঠলো না, তাকে ইতিহাসের মনে রাখার দায় থাকবে না নিশ্চিত। আমি, আপনিও যদি বেঁচে থাকি তাহলে নির্ঘাৎ ভুলেই যাবো কোনও এক বসন্তসময়ে, নিশ্চিন্ত ছন্দে ফিরে যাওয়ার পর। কিন্তু খবরটা পাওয়ার পর,  নিজেদের দিকে তাকাতে সমস্যা হচ্ছে— এটাও তো সত্য।

তেলেঙ্গানার মরিচক্ষেতে কাজ করে বাড়ির খরচ নির্বাহ করা বারো বছরের জামলো মাকদাম লকডাউনে দিশেহারা হয়ে, ছত্তিশগড়ের বিজাপুরে নিজের গ্রামে ফেরার জন্য রওনা দিয়েছিল। সঙ্গে ছিল ওই ক্ষেতেই কাজ করা, ওই গ্রামেরই আরও জনা বারো কচিকাঁচা। হাইওয়ের বিভীষিকা এড়াতে জঙ্গলের গভীর দিয়ে পথ কেটে কেটে চলছিল ওরা, যমের হাত ধরেই। ওরা ছিল অভূক্ত এবং ধরে নিচ্ছি,  জলহীনও। জামলোর মৃত্যুর কারণও তাই জানিয়েছে জেলা মেডিক্যাল বোর্ড।

টানা তিনদিন কীভাবে হেঁটেছিল বছর বারোর জামলোরা! ভাবতে পারেন ? টানা তিনদিন। নিজের বাড়ি ফেরার স্বপ্ন যে এত তীব্র হয়, এতটাই শক্তি দিতে পারে তা আমরা প্রিভিলেজড ক্লাস কখনই বুঝবো না যদিও। সেই স্বপ্ন থেকে ঠিক চোদ্দ কিলোমিটার আগে আর পেরে উঠলো না, ওর হাঁটা থেমে গেল। প্রবল পেটের যন্ত্রণায় হুমড়ি খেয়ে সব শেষ।

মানুষ অকৃতজ্ঞ। ওর পরিবারও, বোঝাই যাচ্ছে আরও কোটি কোটি পরিবারের মতনই অসহায়। সরকার একলাখ টাকা দেবে বলে জানিয়েছে পরিবারকে,  চোখের জল দ্রুত শুকিয়ে যাবে। কিন্তু এই মারণযুদ্ধের মধ্যে যে পিপুল গাছতলা, ওর ক্ষণস্থায়ী শৈশবের মত গাঁয়ের আকাশ, জলখেলার ঘাট, খাটিয়ার তলার বাক্সে লুকিয়ে রাখা ভাঙা কাঠপুতলিটার কাছে ও পৌঁছাতে প্রাণপণ করেছিল, তারা ওকে মনে রাখবে এটা আশা করতে ভাল লাগছে। তবে সে বড় ফঙ্গবেনে আশা।

শুধু কি শহর থেকে গ্রামে ফিরতে না পেরে হুমড়ি খেয়েছে মানুষ?  অন্য একটি সত্যি হলেও গল্পের দিকে তাকানো যাক।


পটাশপুরের বুড়ো বটগাছতলার উল্টো দিকের পুকুর পেরিয়েই এক চিলতে জমি। সেটাই ওদের বিকেলে বল খেলার মাঠ। দরিয়াগঞ্জের সরু গলির একটা ছোট কামরায় টানা ৫০ দিন আটকে থাকার সময় মন খারাপ হলেই বছর দশেকের নির্মল চোখ বুজে মাঠটার কথা ভাবত। ওটাই ছিল কষ্ট সহ্য করার অক্সিজেন। সেই স্বপ্নের মাঠে ফেরার জন্য বাবা মা-র হাত ধরে নয়াদিল্লি স্টেশনের ৬ নম্বর প্ল্যাটফর্মে সকাল সকাল পৌঁছে গিয়েছিল ওরা। ট্রেন যেন কোনও মতেই ছেড়ে না যায়! দেশ জোড়া দেশজোড়া লকডাউন চালু হওয়ার ৫০তম দিনে দিল্লি থেকে হাওড়াগামী প্রথম ট্রেনটি যেদিন ছাড়ল। নির্মলের বাবা গোপাল সরকারের মুখে ছেলের মতো হাসি না থাকলেও স্বস্তির ছাপ।  মুখোশের ওপার থেকে এই প্রতিবেদককে তিনি সেদিন বলছেন, “অমৃতসর বেড়াতে গিয়েছিলাম। ২৬ মার্চ বাড়ি ফেরার টিকিট কাটা ছিল দিল্লি থেকে। সেই মতো কদিন আগেই দিল্লি এসে দরিয়াগঞ্জের হোটেলে ছিলাম একটু ঘুরে দেখব বলে।’’ থাকার কথা ছিল তিন দিন, থাকতে হল প্রায় সাত সপ্তাহ! বলেছিলেন, “পুলিশ সাহায্য না করলে পারতাম না। ওরা এসে হোটেলের সঙ্গে কথা বলে সব ব্যবস্থা করেছিল। আমরা একটা থোক টাকা দিয়ে একটা ঘরে থাকতে পেরেছি। হোটেল মালিক থাকতে দিয়েছেন পুলিশের হুমকিতে। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও করে পুলিশই।’’ সেদিন যাঁরা ফেরার টিকিট হাতে পেয়েছিলেন, তাঁদের বক্তব্য,  লটারি পেলেও এত আনন্দ হত না।  


সেই প্রথম হাওড়া ছাড়াও লুধিয়ানা, পটনা-সহ সাতটি গন্তব্যের ট্রেন ছেড়েছিল। যদি কিছু হয় ফিরে গিয়ে হবে। নিজের মাটিতে নিজের লোকের সামনে হবে,’’ বলেছিলেন নদিয়ার মলয়কুমার দাস। করোলবাগে সোনার দোকানে কাজ করতেন। কী ভাবে কাটিয়েছি লকডাউনে, তা না বলাই ভাল। আমাদের তো হাতে টাকা দেওয়া হয় না, সোনার লেনদেন হয়। অর্থাৎ বেতনের সমপরিমাণ সোনার কুচি কেটে দেয় মালিক। হঠাৎ সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, খাওয়ার টাকাও ছিল না। শেষ দিকে একবেলা খেতাম। বাড়ি থেকে টাকা পাঠানোয় টিকিট কাটতে পেরেছি।’’

নিজের রাজ্যে ফিরলেও লড়াইটা শেষ হয়নি।  বিভিন্ন জেলা এবং গ্রামে পৌঁছাচ্ছেন পৌঁছেছেন লাখ লাখ মানুষ ওই মলয়কুমার দাসদের মতনই। করোনার হাত থেকে যদিও বা বেঁচেও যান, তাঁর পরিবারের ভরণপোষণের কি হবে, কীভাবে জুটবে কাজ তা বহু বহু ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রযন্ত্রের জানা নেই। যেন দুর্গ এবং কারাগারে ভাগ হয়ে গিয়েছে  যুদ্ধক্ষেত্র। মাঝখানে ঝুলে আছে ত্রাস, আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা। গোটা দিনই, রাত হয়ে থাকা শুনশান সড়ক দিয়ে হোঁচট খেতে খেতে এগো্চ্ছে অর্ধমৃত, অর্ধভূক্ত মানুষের মিছিল। ধীরে বইছে না, আদৌ ধীরে বইছে না, সব কিছু বদলে দেওয়া করোনা-বাতাস।


একদিন ঘুম থেকে উঠে গ্রেগর সামসা নামক এক উপন্যাস-চরিত্র দেখেছিল, সে দশটা-পাঁচটা, মিটিং-কাফে, অপেরা-জীবনে মিসফিট। তার মস্তিষ্কের ধুসর গহ্বর থেকে যৌন রাজনীতি সবই বদলে গিয়েছে কোনও ম্যাজিক দুর্ঘটনায়। একটি ঘুমের মধ্যেই কেউ তাকে বদলে দিয়েছে এক আতঙ্কিত পোকায়।

কোনও ম্যাজিক-উপন্যাস বা ডিস্টোপিয়ান ফিল্ম নয়। এ এখন এক অঘোর বাস্তব। যতদূরে চোখ যায় তা তো এক অন্য পৃথিবীর প্রিল্যুড। এই পর্বান্তরের ধ্বংসলীলার থেকে দূরে থাকবো এবং অন্যকেও দূরে রাখবো বলে আমি ও আমাদের মত অসংখ্য মানুষ যে যার মত সংস্থান, বস্তা বোঝাই করে ঘরে নিয়ে এসে হ্যান্ডওয়াশ. ফিনাইল, আরও বিভিন্ন কীটানুনাশক দিয়ে গড়ে নিয়েছি দুর্গ। ফ্রিজ এবং কিচেনে রেখে দেওয়া হয়েছে যুদ্ধকালীন রসদ। কারও পনেরো দিন, কারও কুড়ি বা আরও বেশিদিনের। সব বড় শহরের মতনই বোধহয়, শাহী দিল্লির যে জনপদ যত অভিজাত, সেখানে এই দুর্গ ততোই নিশ্ছিদ্র। যতো বেশি উচ্চকোটি মানুষ, সেখানে তত আতঙ্ক ও সতর্কতা।


এই দুর্গ মানচিত্রের মধ্যে ছডি়য়ে রয়েছে বেশ কিছু লাল জোন। দিল্লিতে যা প্রায় একশোর কাছাকাছি। যার পোশাকি নাম দেওয়া হয়েছে কনটেইনমেন্ট জোন। অর্থাৎ করোনা-কারাগার। সেখানে গাদাগাদি করে এউ লেখাটি পাঠানোর সময়েও, রয়েছেন বিভিন্ন রাজ্যের শ্রমিক, পথবাসী, গৃহহীন, গতিহীন। বিহার ঝাড়খন্ড, বাংলা, উত্তরপ্রদেশ, তেলেঙ্গানার দেশগাঁয়ের স্মৃতি এদের যথা যথাসম্বল ঝোলায়।

এর বাইরে দিল্লি শহর জুড়ে রয়েছে অন্তত গোটা ষাটেক ক্ষুধানিবারণ কেন্দ্র বা হাঙ্গার সেন্টার! ঠা ঠা রোদে হাতে যে যে পাত্র পাচ্ছেন, নিয়ে চকে মেপে দেওয়া লাইনে দাঁড়াচ্ছেন সেইসব রাজপথে যা মাত্র পৌনে দু মাস আগেই অডি টয়োটো বিএমডবলিউ-এর গতির কাছে জব্দ থাকতো।


কিন্তু এই কারাগার, এই অন্নপূর্ণার জন্য দেওয়া লাইন থেকে ছিটকে আসা হাত ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে। যা কখনও পূর্ব বা দক্ষিণ দিল্লির পশ মার্কেটে হয়ে উঠছে ভিক্ষার হাত। আবার বিকাশ নগর, উত্তম নগরের মত প্রান্তিক জনপদে সেই হাত ছিনতাই করছে, কেড়ে নিচ্ছে অন্যের হাতের বাজারের ব্যাগ। এই ঝড় কতদিনের, বিশ্বের কেউ জানে না। টেস্ট বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দিল্লিতে বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। নিজামুদ্দিনে তবলিগি জামাতের সমাবেশের ধাক্কা গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়লেও সবচেয়ে বেশি চোট লেগেছে স্বাভাবিকভাবেই রাজধানীতেই। এখানকার কেজরীবাল সরকার প্রাথমিক বিষ ঘুম কাটিয়ে নড়েচড়ে বসল যখন, যথেষ্ট দেরি হয়ে গিয়েছিল। এখন লকডাউন তাই কড়া থেকে কড়াতম। স্থানীয় সংবাদ, মে মাসেও অর্থনীতির চাকা গড়ানো এখানে প্রায় অসম্ভব। ততোদিন পর্যন্ত খাবারের জোগান গণবন্টন ব্যবস্থায় থাকবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়ে যাচ্ছে।

সব মিলিয়ে ঝড় মিটলে কে কীভাবে থাকবো, আজকের তারিখে সেটাও সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। কিন্তু পরিস্থিতি এরকম চললে শুধু দিল্লিই তো নয়, গোটা দেশই ভিতর থেকে ফেটে যেতে পারে ত স্পষ্ট। জীববিজ্ঞানের তোয়াক্কা অর্থনীতি করে না। দিল্লির মার্কেট কমপ্লেক্সগুলোতে গিয়ে দেখছি প্রতিদিন ভিড় বাড়ছে। শব্জি ডাল চাল ডিম ওষুধ এমনকি চিপস চকোলেট কেনার ভিড়ের কথা বলছি না। প্রতিটি দোকানের কাছকাছি শান বাঁধানো চত্বরে নোংরা ঝোলা এবং কোলে শিশু নিয়ে অভুক্ত মানুষেরা বসে আছেন যদি কোনও উপায়ে পেট ভরে। উপায় আপাতত একটাই, ভিক্ষা।  তাঁদের চেহারা দেখে এবং কথা বলে বোঝা যায়,  কেউই প্রায় আগে এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করেননি। এঁরা পরিযায়ী শ্রমিকও নন, স্থানীয় ব়ড়জোর এনসিআর এলাকার শ্রমিক, ছোট খাটো উদ্যোগে ঠিকে কাজ করা দিন-আনা মানুষ। দিল্লি সরকারের নেতৃত্বে গোটা শহরে পাঁচশোর উপর সেন্টারে দুবেলা খাবার লাইন উপচে পড়ছে। তারপরেও এই রাতারাতি ভিখিরি হয়ে যাওয়া মানুষের মিছিল দীর্ঘতর। রাজধানীর পশ মার্কেট সেন্টার-এই যদি এই হাল হয়, তাহলে গোটা ভারতবর্ষের চেহারাটা অনুমান করতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।


পলিউশন ইনডিক্সে দেশের সবচেয়ে ভালনারেবল জোনে থাকা দিল্লির বাতাস অবশ্য চোখের সামনে বদলে গেল এ কদিনে। "এবং আকাশ আজ দেবতার ছেলেমেয়েদের নীল শার্ট পাজামার মতো বাস্তবিক"...l রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাওয়ার সময় আকাশের দিকে তাকালে, বাবা-র আমাকে তারা চেনানোর ছোটবেলার দিনগুলো মনে পড়ছে। এমন নক্ষত্রখচিত রাত দিল্লি শেষ কবে দেখেছে কে জানে! সামনের পার্ক সংলগ্ন গাছপালা তো সেলিম আলির বই হয়ে আছে যেন! নাম-না-জানা পাখিদের তুমুল অর্কেস্ট্রা গোটা দিন।

আজ ভোরে শুনলাম একটা নতুন ডাক। নাগাড়ে এক ঘন্টা ঠিক এভাবেই তীব্র শিষধ্বনি দিয়ে পাখিটা অবিকল বলে গেল, ‘স্টে টিউন়ড, স্টে টিউন়ডস্টে টিউনড….!

ছবিগুলি লেখকের তোলা



Post a Comment from facebook

1 Comments

  1. দু'জন মিলে লেখাটি পড়ছিলাম। পাঠ শেষ না হতেই একজন বলে উঠলেন, মানুষের জন্য এই সব দুর্দশা যেনো মানুষেরই তৈরি করা।

    ReplyDelete

Post a Comment

Previous Post Next Post