অবসরপ্রাপ্ত রাজ্য-সরকারী প্রশাসনিক অধিকর্তা। কিন্তু পেশা দিয়ে নয় লেখা দিয়েই তাঁকে চেনেন অধিকাংশ মানুষ। সত্তর দশক থেকে তাঁর কবিতাভ্রমণ আজও জারি নানা বাঁক-সহ।

 করোনা ভাইরাস এবং কিছু প্রাসঙ্গিক শব্দ

প্রশান্ত গুহমজুমদার


শেষ ১০০ বা আরো কিছু বেশি দিন ধরে কোভিড ১৯ বা করোনা ভাইরাস নিয়ে বাংলা ভাষায় এত কিছু আলোচনা হয়েছে যে, শিক্ষিত আগ্রহী বাঙালীর এই ভাইরাস নিয়ে সাধারণ ভাবে অজানা প্রায় কিছুই নেই। এই ভাইরাসের মারণ ক্ষমতা, এর সংক্রামক ক্ষমতা আগ্রহী মানুষ খবরের বিভিন্ন মাধ্যম থেকে কিংবা আন্তর্জালের মাধ্যমে জেনেছেন। মৃত্যুর হার, তার বিস্তৃত পরিসংখ্যান প্রায় সব শিক্ষিত মানুষ জেনেছেন এবং আপাতভাবে এই ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নানাবিধ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সরকারী নির্দেশ অনুসারে বা স্বেচ্ছায় গ্রহন করছেন। যথাযথ প্রতিষেধক যেহেতু এখনো নাগালের বাইরে, প্রিভেনশনের বিষয়ে সরকারীভাবেও নানান ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জনসচেতনার জন্য প্রয়োজনীয় প্রচার, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য আবেদন বা নির্দেশ, লকডাউন, কার্ফু, পুলিশ প্রশাসনিক ব্যবস্থা কম কিছু নেওয়া হয় নি বা হচ্ছে না। চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ সেবাপরায়ণ মানুষ উপযুক্ত প্রতিরোধী ব্যবস্থা ব্যতীতই, অসংযমী জনতার হাতে অহরহ নিগৃহীত হওয়া সত্ত্বেও যে সাধ্যাতীত অমানুষিক পরিশ্রম করে চলেছেন, কোনও শব্দেই সে কাজকে যথাযথভাবে সম্মান জানানো অসম্ভব।  তবু তাঁরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এমন কি সাংস্কৃতিক শাখাতেও চলছে প্রচার। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে যে, যে অঞ্চল বা দেশে এ সমস্ত বিধি সাধারণ  মানুষের মধ্যে যথোচিত গুরুত্ব পেয়েছে, সেখানে এই অসুখ ছড়িয়ে পড়ার হার যথেষ্ট কম। শ্লাঘার সঙ্গেই বলা যায়, চীন বা ভারতের মত জনবহুল এবং জনঘনত্বের দেশে এখনো এর সংক্রমণ তুলনামূলক ভাবে যথেষ্ট কম। আমেরিকায় জনঘনত্ব প্রতি বর্গমাইলে ৯৪, অথচ সেখানে ইতিমধ্যেই আক্রান্তের সংখ্যা ১৮২০৭৯৬ ছাড়িয়েছে, মৃত্যু ঘটেছে ১০৫,৬৪৫ মানুষের। ভারতের জনঘনত্ব  প্রতি বর্গ কিমিতে ৪৬৪, অথচ সেখানে এখন অবধি আক্রান্ত অনধিক ১৮২৬৬৮ এবং মৃত্যু ঘটেছে ৫২২৪, সুস্থ হয়েছেন ৮৮৩৭৬-এর কিছু বেশি । আত্মপ্রসাদের কিছু নেই, তবু আমাদের দেশের মানুষের সচেতনতা নিয়ে ভাবতে গেলে খারাপ লাগে না। এই সামান্য তথ্য থেকে বোঝাই যায়, ভারতের মানুষ সচেতন এবং প্রতিরোধক ব্যবস্থা প্রায় যথোচিত। 

প্রাসঙ্গিক ভাবে অন্য কিছু মহামারী কিংবা সারা বছরের নানান হেতুতে মৃত্যুর সংখ্যা জানতে ইচ্ছে হয়। প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে ২০১৭ সালে গত হয়েছেন টিউবারকুলোসিসে ১.১৮ মিলিয়ন মানুষ, ক্যান্সারে ৯.৫৬ মিলিয়ন,  ৬১৯৮২৭ জন চলে গিয়েছেন ম্যালেরিয়ায়, এ ভাবে নানান কারণে সব মিলিয়ে মৃত্যু ঘটেছে ১৬ মিলিয়ন মানুষের, অপুষ্টিজনিত কারণে ৫ থেকে ১৪ বছরের শিশুদের ২৩১,৭৭১ জন, মাতৃত্বকালীন জটিলতায় ১৯৩,৬৩৯ জন। ২০১৭ সালে  প্রদত্ত তথ্য থেকে আরো জানা গেল, ভারতে ১.০৪ লক্ষ শিশুদের মধ্যে পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের মধ্যে ৬৮% শিশু অকালেই চলে যায় কেবল অপুষ্টির কারণে।  Corinna Hawkes, co-chairperson of the Report and Director of the Centre for Food Policy, জানিয়েছিলেন,  “The figures call for immediate action. Malnutrition is responsible for more ill-health than any other cause. The health consequences of overweight and obesity contribute to an estimated four million deaths, while under nutrition explains around 45% of deaths among children under five. The uncomfortable question is not so much “why are things so bad?” but “why things are not better when we know so much more than before?” ”  Henrietta H Fore, Executive Director, UNICEF বলছেন, “This paradigm shift – food systems that contribute to prevent malnutrition in all its forms – will be critical for children’s growth and development, the growth of national economies, and the development of nations.”  এ সব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে (https://ourworldindata.org) প্রদত্ত তথ্য থেকে। বলাই বাহুল্য, এই সব তথ্য প্রায় সমস্ত উন্নতশীল দেশসমূহে যথোচিত গুরুত্ব পেয়েছে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ  করা হয়েছে।

বহুতর হেতুতে এত মৃত্যুর আবহে,  কোভিড-১৯ এর সঙ্গে লড়াইয়ে এমন অতিমানবিক পরিশ্রমের পরেও এখন আমরা আর এই তথ্য, এই পরিসংখ্যান নিয়ে কথা বলব না। বিভিন্ন মাধ্যমে নিয়মিত আপডেশনের ফলে প্রতিদিন উৎসুক মানুষ কোভিড-আক্রান্তের সংখ্যা, সুস্থ হয়ে ওঠার সংখ্যা এবং মৃত্যুর হিসেব পেয়ে যাচ্ছেন। কখনো উদ্বিগ্ন হচ্ছি, কখনো বা স্বস্তি।

 বরঞ্চ এই ভাইরাসজনিত অন্য একটা বিষয় নিয়ে,  অপ্রত্যাশিত কিছু বিলম্বজনিত পদক্ষেপ গ্রহনের কারণে কিছু মৃত্যু, কিছু যন্ত্রনা, কিছু ভয় আর অন্তহীন ক্ষুধা নিয়ে সামান্য দুচার কথা বলা যেতে পারে। সেটা হচ্ছে বিভিন্ন রাজ্য থেকে বিভিন্ন রাজ্যে একটু বেঁচে থাকার জন্য, সামান্য আর্থিক নিশ্চয়তা পাওয়ার আশায় যাতায়াতকারী বিভিন্ন ধরনের পেশা-র শ্রমিকদের কথা। ‘পরিযায়ী’ শব্দটায় আপত্তি আছে। কেমন যেন অবহেলার গন্ধ।  যখন মৃত্যুর সংখ্যা, সুস্থ হয়ে ওঠার সংখ্যা নিয়ে আমরা ভয়ে ভয়ে নিরাপদ দূরত্বে বসে আলোচনায় ব্যস্ত, সে সময়ে নিজের ঘর থেকে বহুদূরে রুটিরুজি জোগাড়ের কাজে অভিযোজিত লক্ষ শ্রমিকের, তাদের বিষয় তেমন গুরুত্ব পায় নি। প্রধানত মিডিয়ার তৎপরতায় এই সব হতভাগ্য শ্রমিকদের কথা আলোচ্য বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছে। এবার এদের নিয়ে আমার ভাবনা বিষয়ে আসি।

প্রথমত, এই সব হতভাগ্য শ্রমিক, যাদের কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষ হিসেবে দেখা অমানবিক, নিজস্ব ঘর পরিবার পিছনে রেখে অন্য অঞ্চলে যায় কেন! সহজ উত্তর,  নিজের দেশে কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই বলে অথবা কম পারিশ্রমিক পায় বলে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও এরা যায়।

এই ভারতেই তারা বিভিন্ন রাজ্যে যায়, শ্রম দেয়, পয়সা পায়, সেখানেই ঘরসংসার পাতে অথবা ছুটিতে উৎসবে ঘরে ফেরে কিছুদিনের জন্য। এরা বিশেষ কিছু অঞ্চলে নয়, যেখানে এক শ্রেণীর এজেন্ট নিয়ে যায়, সেখানে যায়। উচ্চ পর্যায়ের নির্দিষ্ট মান অনুযায়ী এদের মাসিক বা বাৎসরিক আয় ইতিমধ্যে নির্দিষ্ট কোন শ্রেণীতেই পড়ে না। 

 দ্বিতীয়ত, এদের পিএফ নেই, এদের কোনও বীমা নেই, কেবল বর্তমানটুকু আছে। যা নড়বড়ে এবং সংশয়ব্যাথিত। এদের মাবাবা শারীরিকভাবে ততটা সক্ষম নন, স্ত্রী রক্তাল্পতা জনিত বিভিন্ন অসুখে ভোগে, এদের শিশুরা অপুষ্টি নিয়েই যতদিন পারে, লড়ে যায়। তারপর মরে যায়। কে রাখে সে হিসেব! কিন্তু এদেরও নিজস্ব মুলুকে এক ঘর আছে। যখন বর্তমান তাদের ত্যাগ করে, মুখের উপর কারখানার দরোজা বন্ধ হয়ে যায়, নিরাপত্তাহীনতা যখন চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে ওদের, ওরা ফিরতে চায় সেই ভাঙাচোরা মুলুকেই। এরাও কিন্তু বিশেষ দিনে রাজনৈতিক প্রার্থনাকে মর্যাদা দিয়ে আঙ্গুলের ডগায় কালি লাগিয়ে ঘরে ফেরে। কি, কেন-এসব নিয়ে তারা ভাবে না। সে ভাবনা তাদের নয়। তাদের ভাবনা দুবেলা ভাতের, একটু নিরাপদ ছাদের, যথাসম্ভব পোষাকের। এ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক একটি কথোপকথন তুলে ধরা যেতে পারে। ঘটনাক্রমে শোনা গেল। স্থানঃ মুর্শিদাবাদের জঙ্গীপুর মহকুমা। দুজন শ্রমিক ঘরে ফেরার পথে। দাঁড়িয়েছেন ত্রিপল কিনবেন বলে। এরা কি বলছেন, শোনা যাক। ওরা দুজনেই উড়িষ্যা রাজ্যের পিছিয়ে পরা এলাকায় রাজমিস্ত্রীর কাজ করত। হঠাৎ এই লক ডাউন হয়ে যাওয়ার কারনে দিনকয়েক অপেক্ষা করে। উপায়ান্তর না দেখে সম্বল যা কিছু ব্যাগে আর সিমেন্টের বস্তায় ভরে হাঁটতে শুরু করে। ১৭ দিন ধরে এইভাবে চলতে চলতে দিনকয়েক আগে ভিটে বাড়ির কাছাকাছি পৌছেছে।

আগ্রহ নিয়ে কথা বলা শুরু করি।

শুনুন তাহলে, বলা শুরু করে ওরা। লক ডাউন কাকে বলে জানা ছিলো না। এর কি কি নিয়ম বিধি, তাও পরিস্কারভাবে জানিনা। যার অধীনে কাজে গিয়েছিলাম, সে-ও মোবাইল বন্ধ করে দিয়েছে। বাইরে বেরুলেই পুলিশের ধমকানি। এমতাবস্থায় দুইদিন কাটিয়ে রাতের বেলা অন্ধকারে বেড়িয়ে পড়লাম। খেলাধুলার সাথে যুক্ত ছিলাম, তাই জানতাম এই ম্যারাথন হাঁটার গতি বাড়ানো যাবে না। এক তালে আস্তে আস্তে চলছি তো চলছিই। পথ চলতে চলতে দেখেছি কোন হতভাগ্য মেয়েকে সদ্য মা হতে। দেখেছি বিকলাঙ্গ পুত্রকে সাইকেলে চাপিয়ে বাবার মাইলের পর মাইল চলতে। দেখেছি মরে যাওয়া মায়ের বুকে ছোটো শিশুর অবাক চোখে তাকিয়ে থাকা।

জিগ্যেস করলাম, তোমরা আর যাবে না কাজে? 

হেসে উঠলো ওরা। বললো, উপায় তো নেই। যেতে যে হবেই। আমাদের রাজ্যে তো কোনো কাজ নেই। রাজনীতি করেই দেশটা শেষ হয়ে যাবে একদিন। মরণ আমাদের মত খেটে খাওয়া মানুষদের। বাই দ্য পিপল, অফ দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, এই কথাগুলো শুনতে ভালো হলেও, হচ্ছে কই দাদা??

চমকে উঠলাম। 

তুমি লেখাপড়া কতদূর করেছ? 

হেসে উঠে উত্তর, দোজ হ্যাপি ডেজ গন ইন ডার্ক অব্লিভিয়ান। আর গল্প করলে চলবে না। বাড়ির ছাতটা ত্রিপল দিয়ে ঢাকতে হবে। নইলে সারারাত টপ টপ করে জল পড়বে, ঘুমাতে পারব না। আসি। 

সঙ্গী জানালেন, ও ইংরেজিতে সাম্মানিক স্নাতক।

গলার কাছে একটা দলা পাকানো শক্ত কিছু অনুভব করছি। কষ্টের? আফসোসের? জানি না।

এসবই বোধকরি অতি পরিচিত ছবি, সবারই।

তৃতীয়ত, এই যে যায়, যেতে হয় এদের, তার দায় কার? এরা কি লোভে যায়? অবশ্যই তাই। বেঁচে থাকার লোভে, দুবেলা ক্ষুধানিবৃত্তির তাড়নায়,  বাড়িতে থেকে যাওয়া অসুস্থ বয়স্ক মাবাবা অথবা স্ত্রী পুত্রের দিকে তাকিয়েই তারা যায়। যায়। কিন্তু চোখ মন অহরহ থাকে ঐ দূরে রেখে আসা প্রিয় মানুষদের দিকেই। জন্মভিটেয়, জন্মদেশে যদি এই ন্যূনতম প্রয়োজনের নিশ্চয়তা না থাকে, তবে বেঁচে থাকার, বাঁচিয়ে রাখার লোভেই যায়। যেমন,  বাবুদের ছেলেমেয়েরা বিমানে ওই পশ্চিমের দেশে যায় উন্নত মানের লেখাপড়ার ছলে প্রভূত অর্থের লোভে, দুবাই ইত্যাদি দেশে মনোরঞ্জন করার জন্য অর্থের লোভে যায় সেলিব্রিটি অথবা নৃত্যপটীয়সীবৃন্দ। 

ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ন্যাসভিল, টেনেসি-র রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক তারিক থাচিল জানাচ্ছেন, এই শ্রমিকদের তিনটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে, অন্তর্বর্তী অভিবাসন, অসংগঠিত থাকা এবং চক্রাকার হওয়া। প্রথমত, এই শ্রমিকরা ভারতের মধ্যেকার, পরিযানের গবেষণার অধিকাংশই জুড়ে থাকে যে আন্তর্জাতিক পরিযায়ীরা, তেমন নন। দ্বিতীয়ত, এঁরা অসংগঠিত হবার কারণেই এঁদের কোনও চুক্তি নেই। বহু পরিযায়ী শ্রমিকরা দিনমজুর হিসেবে (যেমন নির্মাণকাজে যুক্ত) বা স্ব-রোজগারি (যেমন ফুটপাথের বিক্রেতা)। এঁদের রোজগারের প্রকৃতিটাই অনিশ্চিত, এবং লকডাউনের মত হঠাৎ কাজ বাতিল হলে তার জন্য এঁদের কোনও সুরক্ষা থাকে না। তৃতীয়ত, অধিকাংশ অভিবাসীদের কোনও নির্দিষ্ট শহর নেই বাস করবার জন্য। খরচসাপেক্ষ এবং আতিথ্যহীন শহরগুলোতে তাঁরা বাধ্যত পরিবারহীন থাকেন। ফলে তাঁরা বছরভর বিভিন্ন শহর ও গ্রামে ঘুরতে থাকেন ভারতের ক্ষেত্রে এঁদের সমস্যা জননীতির আকস্মিকতা। ভারতের অর্থনীতিতে এঁদের অবদান কী? এঁদের কি যথাযথ ও নিখুঁতভাবে নথিভুক্ত করা হয়েছে? সোজা কথায়, না। দুটো কারণে। প্রথমত যেরকম আনুষ্ঠানিকতাহীন ভাবে এঁদের নিয়োগ করা হয়, তাতে এঁদের অর্থনীতিতে অবদান তো দূর, এই জনসংখ্যা কত তারই কোনও নির্ভরযোগ্য সংখ্যা পাওয়া যায় না। এই চক্রাকার পরিযায়ীদের যেসব ক্ষেত্রে মূলত কাজে লাগানো হয়, তার ভিত্তিতে এঁদের অবদানের একটা অনুমানমাত্র আমরা করতে পারি। করোনা সংক্রমণ আটকাতে সামাজিক দূরত্ব নীতি কতটা কার্যকর? আরও সূক্ষ্ণ গবেষণায় দেখা গিয়েছে এই ধরনের পরিযায়ীরা নির্মাণশিল্প, ইটভাটা, খনি, হোটেল ও রেস্তোরাঁ এবং ফুটপাথের বিক্রির মত ক্ষেত্রে মূল চালিকা। এর মধ্যে বেশ কিছু ক্ষেত্র ভারতীয় অর্থনীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এবং ভারতের জিডিপির একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এসব ক্ষেত্র থেকে আসে। সরকারি খতিয়ানের কথা ছাড়াও এই সব পরিযায়ী শ্রমিকদের অবদানের কথা স্বীকার করবার ব্যাপারে সমাজের একটা বড় অংশের অনীহা রয়েছে। এঁরা অত্যাবশকীয় পরিষেবা দিয়ে থাকেন, যে কাজ শহরবাসীরা চান হোক, কিন্তু নিজেরা করতে রাজি নন। ... কোনও কোনও গবেষকের পরিসংখ্যান অনুসারে নির্মাণক্ষেত্র সহ পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা ১২০ মিলিয়ন। সত্যিটা এর মাঝামাঝি হতে পারে, কিন্তু কোনও ভাবেই ১০ মিলিয়নের কয়েক গুণের কম নয়। চক্রাকার পরিযায়ীদের গড় আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে এর চেয়ে বেশি সহমত রয়েছে। বেশিরভাগ গবেষণাই বলছে আর্থিকভাবে এঁরা পিছিয়ে থাকা। ... অধিকাংশ পরিযায়ী শ্রমিকরা ভাড়া করা বদ্ধ ঘরে থাকেন কিংবা ফুটপাথে ঘুমোন, শহরে রেশন সংগ্রহ করবার মত কোনও নথি তাঁদের কাছে থাকে না, শহরে পরিবারের কেউ নেই এবং চালানোর মত সঞ্চয়ও তেমন নেই। এঁরা পুলিশ ও মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের হেনস্থার শিকার হয়ে থাকেন। এঁদের দেখা হয় অপরিচ্ছন্ন, উপদ্রব, মায় অপরাধী হিসেবে। লকডাউন শুরু হলে তাঁদের শহরে থাকার সবচেয়ে বড় কারণটাই নাকচ হয়ে যায় অর্থাৎ শহরের কাজ। এরপর নভেল করোনা ভাইরাসের যা চরিত্র, তাতে পরিযায়ীরা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত যে তাঁরা ফের শহরে কাজের সুযোগ আদৌ পাবেন কিনা। তাহলে কেন তাঁরা পরিবার থেকে দূরে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে থাকবেন! হঠাৎ লকডাউনের ঘোষণা এই জনগোষ্ঠীকে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে তা ভেবে দেখাই ছিল সবচেয়ে কার্যকর ও মানবিক দিক। দীর্ঘকাল লকডাউন চললে এই জনগোষ্ঠী কীভাবে নিজেদের পরিবার থেকে দূরে জীবন কাটাবেন সে কথা ভাবা প্রয়োজন ছিল। দ্বিতীয়ত, পরিযায়ী শ্রমিকরা যেখানে রয়েছেন সেখানে থাকা এবং তাঁদের নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেবার মধ্যে কোনটা বেশি জরুরি তা স্থির করা উচিত ছিল। এর কোনওটাই ঠিকমত পালিত হয়নি।...গরিব পরিযায়ী শ্রমিকদের অবদান স্বীকার করার কোনও পদক্ষেপও আমরা দেখিনি। তাঁদের রাজনৈতিক অধিকার বর্ধনের ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। 

এ হল গিয়ে তারিক থাচিল মহাশয়ের পর্যবেক্ষণ বা অভিজ্ঞতা। খুব ভুল বা অতিরঞ্জিত কিছু বলেছেন উনি? আমরা কী দেখেছি? এইসব শ্রমিকরা দেশগাঁয়ে কাজ পায় না, পেলেও সব সময়ে সারা বছরের জন্য নয়। যা পারিশ্রমিক পায়, সঞ্চয়ের বা স্বাস্থ্যবীমা-র সুযোগ ঘটে না। এজেন্টের হাত ধরে এরা যায় ট্রেনের অসংরক্ষিত  কম্‌পার্টমেন্টে গাদাগাদি করে। ওখানে গিয়ে থাকে ঝুপড়ি কিংবা বস্তিতে। এদের সংখ্যার কোন সঠিক তথ্য নেই। তবে শুনলাম, সম্প্রতি ২৩ লক্ষ এমন শ্রমিকদের ঘরে ফেরানোর ব্যবস্থা হয়েছে। এতদিনে! কি পরিস্থিতিতে,  কবে তাদের এ যাত্রা শেষ হবে, জানি না কেউ। পথে আছেন এখনো বহু মানুষ। উপায়ান্তর নেই। তাই হাঁটছেন। পুরুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, পুত্র অসুস্থ বাবাকে সাইকেলে বা পিঠে নিয়ে চলছেন, মারা যাচ্ছেন, মা মারা যাচ্ছেন, শিশু তার মাকে ঢেকে দিচ্ছে ছেঁড়া চাদর দিয়ে, তবু মানুষ চলছেন। ওই ফেলে আসা ভাঙা ঘরের উপোষী প্রিয় মানুষের মুখ মনে রেখে। 

চতুর্থত, এমন কেন হল! কিছু প্রশ্ন উঠে আসেই। লকডাউনের আগেই কেন এদের ঘরে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হল না! রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার এদেরকে কী হিসেবের মধ্যেই ধরেন নি! ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে এই এত মানুষ থেকে গেল হিসেবের বাইরে! 

পঞ্চমত, করোনাভীতি ছড়িয়েছে বিপুল ভাবে। এদের মধ্যেও হয়ত আক্রান্ত হয়েছেন বহু শ্রমিক স্বাভাবিক কারণেই। এদের পরীক্ষা কে করবেন, কীভাবে করবেন, কোথায় করবেন, পজিটিভদের কোথায় চিকিৎসা হবে, কোয়ারান্টাইন-এ কারা যাবেন, সেখানে ন্যূনতম  কী কী পরিষেবার ব্যবস্থা রয়েছে, আজো স্পষ্ট নয়। স্থানীয় মরমী মানুষের সহযোগিতায় আমবাগান, দীঘির পাড় বা সরকারী উদ্যোগে বিদ্যালয় এমন নানান শিক্ষায়তন,  কিছু বিশেষ চিকিৎসা কেন্দ্র- এসবে আছে উপযুক্ত সাধারণ অতি আবশ্যক ব্যবস্থা। নেই। হিউমিলিয়েশন কী বস্তু, এরা জেনেছেন হাড়ে হাড়ে। এমন কি জন্মভূমিতেও এই আক্রান্ত শ্রমিকসব সামাজিকভাবে ব্রাত্য হয়ে পড়ছেন, নিগৃহীত হচ্ছেন। 

ষষ্টত, ন্যূনতম  কী কী পরিষেবার কতটুকু ব্যবস্থা আছে? সেদিন ২৮এ মে-র এক বাংলা সংবাদ পত্রের থেকে জানা গেল, যে সব বিশেষ শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের অনুমতি নিয়েই ভিন্ন রাজ্য থেকে শ্রমিকদের ঘরে ফেরানো হচ্ছে, সে সব প্রায় মৃত্যু স্পেশাল-এর মত। কোন সময়ের ঠিক নেই, কোন পরিষেবা নেই। এর পরেও ট্রেনের মধ্যেও কী করোনা টেস্ট করিয়ে ভিন্ন কামরায় এদের আনার ব্যবস্থা করা যেত না? যেন নিয়ে আসা হচ্ছে, এই অনেক। কোন কোন রাজ্য আবার এই শ্রমিকদের ফেরাতেও চাইছে না। এ কেমন মানবিক আচরণ! এরা তাহলে যাবে কোথায়? নাকি এখন সর্বহারা বলে, করোনা-আক্রান্ত বলে মৃত্যুই এদের একমাত্র উপশম! সব মরণ নয় তো সমান! অবশ্যই সমান নয়। এই বাংলাতেই এমন ক্ষুধা এবং মৃত্যু দেড়শো বছরে দেখেছি অনেকবার। অবশ্য ‘এক দেশ এক রেশন কার্ড’ নীতি লাগু হলে সামগ্রিক অবস্থা সামান্য বদলে যেতে পারে।

করোনার সংক্রমণ থেকে নাগরিকদের বাঁচানোর জন্য বহুবিধ সদর্থক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ফিরে আসতে পারা শ্রমিকদের জন্য হয়েছে কতটুকু? কোয়ারান্টাইন বা হাসপাতালই কী যথেষ্ট! সামাজিক দূরত্ব রক্ষার তাগিদে, তার অপব্যাখ্যায় এরা তো প্রায় অচ্ছুৎ। এঁদের পরিবারের মানুষ, যারা এখনো সংক্রমিত নয়, তাদের সামাজিক, আর্থিক, মানসিক সেবার জন্য কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? এই ভারতেরই দক্ষিণে কেরল রাজ্য রয়েছে। সেখানে এমন শ্রমিকদের জন্য চিকিৎসা, খাদ্য, পরিচ্ছদ বা মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের প্রয়োজনে যেসব ইতিবাচক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে, সে সব তো অনুসরণযোগ্য হতেই পারতো। নিজস্ব ঘরেই তো এদের কোয়ারান্টাইন করে রাখা যেতে পারতো! এর ফলে তাঁরা অন্তত মানসিক স্বস্তিটুকু হয়ত পেতেন। প্রয়োজন কেবল নিয়মিত সচেতনতার প্রচার, সংক্রমণ বিষয়ে যথোচিত পরীক্ষা, চিকিৎসা এবং অন্যান্য পরিষেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা। 

আগামী দিনে এই ভাইরাস-ঝড় হয়ত সময়ের নিয়মেই থেমে যাবে। ইতিমধ্যে বহু লক্ষ মানুষকে আমরা হারিয়ে ফেলব চিরদিনের জন্য। কিন্তু ঘরে ফিরে আসা বা ফিরে আসার আর্তি নিয়ে হাঁটতে থাকা মানুষগুলোর জন্য দেশগাঁয়ে বেঁচে থাকার রসদ থাকবে কতটুকু, সন্দেহ থেকেই যায়। তখন এঁরা কি করবেন! ক্ষুধাকে পরাজিত করবেন এঁরা কোন আয়ুধে? কোন্‌ আর্থিক, সামাজিক সমস্যার আবর্তে, অন্ধকারে তাঁরা তলিয়ে যাবেন! আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে সামাজিক, আর্থিক সুস্থিতি তখন বজায় থাকবে তো? 



Post a Comment from facebook

1 Comments

  1. কাকু আপনার লেখা বরাবর আমাকে প্রভাবিত করে, এই লেখাটি তথ্য সমৃদ্ধ ও বর্তমান সময়ের সবচেয়ে নিপিড়িত প্রান্তিক মানুষদের দূর্ভোগের বার্তা দেয়। ভালো লাগলো পড়ে।

    ReplyDelete

Post a Comment

Previous Post Next Post