কোভিডকথন
সায়ন চট্টরাজ
কোভিড-১৯ বা ২০১৯ সালে চীনের উহান প্রদেশ-জাত
করোনা ভাইরাস ব্যাধি আজ পৃথিবীজুড়ে এক অভূতপূর্ব অতিমারী হিসাবে অধিষ্ঠিত৷ ১৯৬০
সালে আবিস্কৃত একটি ভাইরাস, যে ভাইরাস পরিবার বার বার নতুন নতুন সদস্যদের আমদানি
করে নানা নামে, মানে কখনো সার্স, কখনো মার্স ইত্যাদি নামে মানুষকে আক্রমণ করেছে,
তা আবার সারা পৃথিবীতে ফিরে এসেছে এক যুগান্তকারী এবং মানব সভ্যতার স্থায়ী
পরিবর্তনকারী রূপে, যা থেকে নিস্কৃতি দিতে ব্যর্থ আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানও৷ তাই
মুখাবরণী এবং কোহল-সমৃদ্ধ বীজাণুনাশক আজ মানবজীবনের অত্যাবশ্যক অঙ্গ! তথ্য বলছে, এই লেখাটি লেখার সময় সারা পৃথিবীতে এই
রোগে আক্রান্ত ৮১ লক্ষাধিক এবং মারা গেছেন প্রায় ৪ লক্ষ ৪০ হাজার জন মানুষ৷
ভারতবর্ষে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যাটা যথাক্রমে সাড়ে ৩ লক্ষ এবং দশ হাজার
ছুঁইছুঁই৷ যদিও শুধু এই শুকনো পরিসংখ্যান দিয়ে কোভিডকে বিচার করা মুশকিল৷ একজন
কোভিড হাসপাতালের ডাক্তার হিসেবে জানি, কী ঘটছে৷ কোভিডের
প্রভাব শুধু শরীরে নয়৷ প্রতিটি মানুষের মননে, যাপনে, আচারে-ব্যবহারে, প্রতিটি
কার্যকলাপে এক অনস্বীকার্য পরিবর্তন এনেছে কোভিড৷ পজ়িটিভ শব্দটি যেখানে
অনাকাঙ্খিত এবং নেগেটিভই কাম্য! আর যে জায়গাগুলোতে পজিটিভ-নেগেটিভের হিসেব রাখা
সম্ভব নয় সেখানে কী আর বলা যেতে পারে? লড়াই করার জন্য যে ন্যূনতম প্রতিরোধী বর্ম
দরকার তাও তো গুণে গুণে ব্যবহার করতে হয় আমাদের৷ ক'জন ডাক্তার, নার্স,
স্বাস্থ্যকর্মী কাজের উৎসাহ পান এমন পরিকাঠামোয়? তাদের মৃত্যু ভয় নেই? নেই পরিবার-পরিজন?
দায়টা বলেই ফেলি৷ আমরা ডাক্তার, নার্স
স্বাস্থ্যকর্মীরা নিধিরাম সর্দার৷ তাই পেটের তাগিদে বলুন বা পেশাগত অভ্যাসে, সেবা
আমাদের করে যেতেই হয়! মানবিক মুখ দেখতে চায় জনগণ, মিডিয়া, রাষ্ট্র! 'কোভিড
যোদ্ধা'— এই গালভরা নামে দাগিয়ে দিয়ে মুখরোচক বীরত্বগাথা
শোনাতে চায়! কিন্তু, বিশ্বাস করুন, এই মৃত্যুপিচ্ছিল কোভিড-কাহিনী মারাত্মকভাবে
মর্মান্তিক এবং রোম্যান্টিকতা-রহিত!
অস্ত্র বলতে প্যারাসিটামল, অ্যাজিথ্রোমাইসিন,
মহা-বিতর্কিত হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ও আরও কিছু ওষুধপত্র, যা আহামরি কিছু নয়৷ কারণ,
আশাব্যঞ্জক ভাবে বেশিরভাগ মানুষ এমনিই সেরে ওঠেন৷ বয়স্ক বা আনুষঙ্গিক দীর্ঘকালীন
অসুখে ভোগা মানুষগুলির বাড়াবাড়ি হলে অক্সিজেন ও ভেন্টিলেটর সাপোর্ট নিয়ে লড়াই৷
তারপর দিনের শেষে বাড়ি ফিরে প্রতিবেশি বা বাড়ির লোকের সামান্যতম সাহায্য না
পাওয়া জীবন৷ সে এক অমানুষিক যন্ত্রনা, কটু বাক্য৷ তখন মনে হয় কাদের জন্য এই
লড়াই!!
জীবনকে মৃত্যু দিয়ে বিয়োগ করলে বিয়োগফল হয়
মর্চুয়ারি উপচে পড়া লাশ৷ যার অনেকেই ভুল ঠিকানা ও ফোন নম্বরে বেওয়ারিশ৷ তাই হয়ত,
আজীবন বুকে আগলে রাখা মা'র মৃত্যু-সংবাদ পেয়েও এবং তাঁর মৃত্যুর কারণ কোভিড নয়
জেনেও কোনো সন্তান নির্দ্বিধায় দূরভাষে বলতে পারেন, "আপনারা 'বডি'টা আপনাদের
মত করে সৎকার করে দিন! আমার পক্ষে 'সুদূর' বর্ধমান থেকে যাওয়া সম্ভব না!"
বা! খুব ছোট্ট, কিন্তু পিন-পয়েন্টেড লেখা। রাষ্ট্র-সমাজ-মানুষ এবং ব্যক্তি-স্বাস্থ্যকর্মীদের অবস্থা ও অবস্থান খুব স্পষ্ট করে লেখা হয়েছে। ভালো লাগলো। ভালো থেকো সায়ন।
ReplyDeletePost a Comment