‘রেশম’ ও ‘জলটুঙ্গি’‒ দুটি লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক। তরুণ কবি ও গদ্যকার।  লিটিল ম্যাগাজিন এর প্রচার ও প্রসারে ছুটে বেড়ান রাজ্যের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে।

অতিমারি, প্ল্যাটোস কেভ ও প্রতীক

শতানীক রায়

 

আমি কল্পনা করতেও ভয় পাচ্ছি যে, আমরা একটা অতমারির কবলে বাস করছি। সময় বলে আদৌ কিছু আছে এখন? সময়কে ছুঁতে পারছি না, সময় জিনিসটা কী— এইসব উদ্ভট কিছু ভাবনাকে মুহূর্ত দিয়ে মাপার চেষ্টায় আরও বেশি সময়ের কাছাকাছি এসে পৌঁছোচ্ছি। আমরা সবাই একা হয়ে পড়েছি। নাকি একাই ছিলাম। বাড়িভরতি মানুষের মধ্যে থেকেও একজন মানুষ যেভাবে একা। ক্রমাগত এই শুকনো ঢেলার মতো কিছু বয়ে বেড়ানো। একে শরীর বলে। বয়ে বেড়াতে হয় একটা গহ্বর যার পূর্ণতা কোথাও নেই। না আছে জীবনে না মরণে। বেঁচে থাকাটাই একটি সুন্দর পূর্ণতা। রোজ সূর্য ওঠার মতো। অস্ত যাওয়ার মতোও। হয়তো সবকিছু। এই সবকিছু নিয়ে একটা দরজার আভাস। সেই দরজাটা নিয়ে বড়ো বেশি নাড়াচাড়া হচ্ছে। বরং দরজাকেই জিজ্ঞাসা করা হোক সে কীভাবে একটা দেওয়াল হয়ে আছে। কীভাবে সবকিছু বয়ে বেড়াতে বেড়াতে জীবন্ত হয়ে ওঠে। এই শুক্র এই থলথলে জীবনে ভেসে যেতে চায় ছড়িয়ে যেতে চায়। এখন মাঝরাতগুলোতে মনে হয়: এই তো এখন করোনাকাল চলছে। এখনও জীবিত আছি।        

আমার পরিচয় যে একজন মানুষ হিসেবে এবং একজন সামাজিক প্রাণী হিসেবে সেই বোধটাই মাঝেমধ্যে সুতো ছেড়ে যাচ্ছে। লেখা ছাড়া আর অন্য কোনো কাজ নেই আমার। লেখার পাশাপাশি যে সম্পাদনার কাজও অল্পস্বল্প করে থাকি এটাও প্রায় ভুলতে বসেছি। মাঝরাতে প্রায় ঘুম ভাঙলেই মনে হয় এই কোন পৃথিবীতে আমরা বেঁচে আছি। বারবার মনে হয় কাম্যুর 'প্লেগ' উপন্যাসের কথা। মানুষের মানসিক বিভ্রান্তির কথা। যখন মহামারির পরিস্থিতি চলছে তখন সবাই বিভ্রান্ত হচ্ছে। এই করোনা আক্রান্তের সময়েও ক্রমাগত দেখে চলেছি এটা। অন্তহীন সব বিভ্রান্তির তলে ডুবে যাওয়ার যে কী করুণ অবস্থা তা টের পাচ্ছি। আমার মতে আরও বিভ্রম অপেক্ষা করে আছে। আমার সম্পাদক সত্তা নিয়ে বলছিলাম। আমি জলটুঙ্গি নামে একটি পত্রিকা এককভাবে সম্পাদনা করি। আসলে এই কাগজটিকে শুরু থেকেই আমি গবেষণাধর্মী করতে চেয়েছি। বছরের পর বছর কাজ চলার পর তা প্রকাশ পায়। গতবারের সংখ্যা 'ডায়েরি সংখ্যা', প্রায় দুই বছর কাজ করার পর প্রকাশিত হয়েছিল। এবারেও আরেকটি সংখ্যার কাজ ২০১৮ সাল থেকে শুরু করে এবার ২০২০ সালে বেরোনোর কথা ছিল। এই করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর আমাদের জনজীবনের মানচিত্রই পালটে গেল। আমরা ভুলে গেলাম কত কিছু। আমার তো এখন প্রায়ই দিন-ক্ষণ-বার-বেলা সময়ের তালগোল পাকিয়ে যায়। পাশাপাশি রেশম পত্রিকাও আমি বিপ্লব চক্রবর্তীর সঙ্গে যুগ্মভাবে সম্পাদনা করি। এই পত্রিকার এবারের সংখ্যার ক্রোড়পত্র হওয়ার কথা ছিল আলব্যের কাম্যুকে নিয়ে। পত্রিকার কাজ প্রায় শেষ এমন সময় এই অতিমারি সব সীমারেখা মুছে দিল। 

এই ঘন সময়কালে সমস্ত উদ্ভট চিন্তাভাবনা আমার মাথায় ঘোরে। কখনো কোনো শিল্পীর কোনো চিত্রকর্মের প্রতীকগুলো নিয়ে ভাবতে বসি। এই তো গতকালই ১৪ই জুন পল ক্লির কবিতা পড়তে বসলাম। তাও আবার মাঝরাতে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কবিতা লিখেছেন তিনি। তাও খুব অল্প। তাঁর বিভিন্ন সময়র ডায়েরি পড়লে আমরা কবিতার মতো পঙক্তি দেখি। এক-একটা এন্ট্রি শুধু কবিতাই। হয়তো-বা অনুভূতি তবুও কবিতাই। পল ক্লির ছবিও ভীষণভাবে আধ্যাত্মিক ও কবিত্বময়। এক-একটা চিত্রকর্মের বিপুলতা ও রঙের বৈচিত্র্য দেখতে দেখতেই সময় চলে যাচ্ছে যেন। এই করোনাকালের জীবন যেন সর্বোতভাবে প্রতীকী। এর আদৌ কোনো বাস্তব আছে কি? এই প্রশ্নের সামনে বসে থাকতে থাকতে অদ্ভুত হয়ে উঠছি যেন। ক্লির 'স্বপ্ন' নামক একটা কবিতা পড়া যাক: 

 

স্বপ্ন

 

আমি দেখছি

আমার বাড়ি: শূন্য

নিঃশেষ

সমস্ত মদ

 

নদী

দিশা পরিবর্তন করেছে

হরণ করেছে

আমার সমস্ত উল্লাস

 

মুছে দিয়েছে

সমাধিফলক

সাদার

মধ্যে সাদা। 

                         

দুটো জগৎ পাশাপাশি কাজ করছে। একটি বাস্তব আরেকটি প্রতীকী। এই প্রতীকীও এক ধরনের বাস্তব এখানে। এমন দুর্বিষহ সময়ে প্রতীকী ভেবে নেওয়ার মধ্যে একটা আরাম আছে। আমার নিজস্ব অনুভূতি থেকে বলতে পারি যে, প্রতীকের অবদান হল আমাদের চিন্তাশীলতার ব্যাপ্তি ঘটানো। চারপাশের সবকিছুই যদি প্রতীকের ভেতর দিয়ে দেখি তাহলে এক মহাজাগতিক আরামবোধ তৈরি হয়। কাম্যু 'প্লেগ' লিখলেন এবং সেটা যে শুধু প্লেগের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল তা কিন্তু নয়। তার বাইরেও যে চিরন্তন অ্যাবসার্ডিটির ভেতর থেকেই প্লেগকে দেখা সময়কে অনুভব করা। যেখানে সময়ের কোনো অস্তিত্ব সাধারণত নেই। আমার এই ব্যাপ্ত জীবনের সময়কালে একটা শরীর বয়ে নিয়ে চলা এটার ভেতরেও কিন্তু একটা কনসেনট্রেটেড পিণ্ড যার অনুভূতির বলয়ের মধ্যে সময়ের অবস্থান কোথায়? এর কোনো সদুত্তর নেই। কারণই হল টাইম আর স্পেস এটা পুরোটাই নির্ভর করে মনন এবং শূন্যতার অবস্থানের ওপর। ঘন জলের মতো জীবন কিন্তু জীবন তো আর জল নয়। 

এই যে আমি সম্পাদক কিন্তু আমি সম্পাদকের ভূমিকা পালন করতে পারছি না। যা কিছু পত্রিকার পরিকল্পনা স্মৃতিবিভ্রম হচ্ছে। এরকম একটা বিভ্রমকে স্বীকার করেই আস্তে আস্তে নিজেকে সামলে রাখতে হচ্ছে। পুনরায় গুছিয়ে নিতে হচ্ছে। গোছাতে গোছাতে আবার তাল হারিয়ে যাচ্ছে। আবার শুনছি লকডাউন শুরু হবে। কবে ছাপা পত্রিকা বেরোবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবুও নিজের ল্যাপটপে সব গুছিয়ে রাখতে হবে। দেখে নিতে হবে পুরোনো পরিকল্পনার সুর কি এখনও মগজে একইরূপে বিরাজ করছে? অতিমারি এসে সবকিছু ঘোলাটে করে দিল। বারবার আমরা রাষ্ট্রশক্তিকে দোষ দিয়ে চলেছি। কিন্তু একবারও ভাবছি না, আমরা কতটা সতর্ক আছি। কীভাবে মানুষজনের সঙ্গে মিশছি। কীভাবে আমাদের ইন্টার‌্যাকশন হচ্ছে প্রতিটি নন লিভিং অবজেক্টের সঙ্গে। দূর দূর অবধি যেখানেই চোখ যাচ্ছে কেমন ঘুম থেকে ওঠার পর যেরকম মনে হয়। পাহাড়ের উপর বসে কেউ গান করছে আমি তার নাগাল পাচ্ছি না। এও একটি ঘোর চূড়ান্ত নির্বিশেষ একটা সময়ে এসে নিজেকে বেসামাল করে তোলা। আসলে সামলানোর পরিকল্পনায় আমাকে বারবার ফিরে আসতে হচ্ছে ক্রিয়ার মূল সূচনাতে। মনে পড়ে যাচ্ছে কাফকার ডায়েরির একটি এন্ট্রি। ১৯শে জুলাই ১৯১০। কাফকা বারবার দোষ দিচ্ছেন শিক্ষা ব্যবস্থাকে, বাবা-মা, শিক্ষকদের এবং ওঁর কাছের সবাইকে। আস্তে আস্তে স্তবকের পর স্তবক পেরিয়ে যাচ্ছে। টের পাচ্ছি ওঁর ক্ষোভের অনুরণন কমে আসছে। ক্রমশ যুক্তিনির্ভর হয়ে উঠছেন। আর স্বীকৃতিহীন একটা জীবনের কাহিনি বলে চলেছেন। ক্ষোভ মুছে গিয়ে নিজের দিকেই তিরটি ঘুরিয়ে দিচ্ছেন। ক্ষোভ কেন বা বিভ্রান্তি কেন এটার পর কাফকা এই ক্ষোভের প্রতিফলন নিয়ে ভাবছেন। এরকম করে একটা সময় ক্ষোভ হারিয়ে চূড়ান্ত একটা ক্ষমার ভেতর আশ্রয় নিচ্ছেন। এটা গল্পের মতোই মনে হয়। দীর্ঘ আখ্যান।          

আখ্যানের মতো এই ভাঙচুরের সময়ে আমাকে স্থিরচিত্তে পত্রিকার কাজ অগোচরে করে যেতে হচ্ছে। দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হচ্ছে নিজেরই ভেতর। পাশাপাশি আরও দুটো পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত আমি। তবুও প্রয়াস পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর একজন হলাম আমি। এই সময় ওয়েবসাইটে আমরা নিয়মিত লেখা প্রকাশ করে চলেছি। সম্পাদনা করতে গিয়ে নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীনও হয়ে চলেছি। আরও বেশি অন্তর্মুখী হয়ে সম্পাদনায় মন দিতে পারছি। তবুও যেহেতু অনেকদিন ধরে গৃহবন্দী তার একটা অবসাদ আমার মনে পড়ছেই। আরেকটি প্রিন্টেড জার্নাল 'শাকবোল'-এর আমি সহসম্পাদক। এবার ওখানে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় সংখ্যা ও রবীন্দ্র গুহ ক্রোড়পত্র হওয়ার পরিকল্পনা চলছিল। কাজও এগোনোর পর এখন সব স্থগিত। ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত আমরা। তবে একটা শিক্ষা আমি অন্তত পেয়েছি। জলটুঙ্গি পত্রিকার বহু লেখাকে অনেক সময় নিয়ে পড়া এবং সম্পাদনা করার সময়টা আমি পেলাম। এতে আমার মনে হয় আরও নতুন মাত্রা যোগ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে সম্পাদক হিসেবেও আমার ভুল ট্রুটিগুলোও আবিষ্কার করতে পারছি। এই অতিমারি আমার কাছে এক অদ্ভুত দিগন্ত খুলে দিল যেন।           

আবার পাশাপাশি সমান্তরালভাবে আরেকটি জীবন বয়ে চলেছে। এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা সময়ের সীমারেখা মুছে দিতে চাইছে। বাঘ সিংহের অবয়বে ঢাকা যেন। প্লেটোর 'Allegory of the Cave' মনে পড়ছে। অনেক বছর গুহায় থাকার পর যখন বাইরে ফিরব তখন আদৌ কি নিজের আগের স্বভাববৈচিত্রে ফিরতে পারব? এরকম একটা বোধের দ্বারা আক্রান্ত হতে হতে মনে হতে থাকে নীৎশের অ্যাফোরিজমে বাঁধানো ছোটো ছোটো চৌকো বহুকৌণিক জগৎ। অদ্ভুত বাক্যগঠনে ভাবনাকে আটকে রাখেন উনি। বারবার সমে ফিরতে গিয়েও কোথাও দূরে ফসকে যান। এই সময় শুধু কোনো চিরকালীন এক অ্যাবসার্ড বিমূর্ততা নিয়ে চলতে চলতে হারিয়ে যায়। কী হারিয়ে যায়— এর কোনো যৌক্তিকতা নেই। যেমন এই সময়ে আমি সম্পাদক হিসেবে ভূমিকা পালন করে গেলেও তার কোনো যৌক্তিকতা নেই।   



Post a Comment from facebook

4 Comments

  1. চিন্তার অনেক উপাদান দিলে। প্রতীকের অবদানের যে সূত্রটা তোমার মাথায় এসেছে তা একাই এমন একটা চাবি যা বহু দুয়ারের সম্ভাব্যতাকে নির্দেশ দেয়। তুমি পন্ডিত মানুষ। অভিজ্ঞতা বর্নণেও তা নির্ভুল আসে।

    ReplyDelete
  2. ভালো লাগলো বেশ। ব্যক্তিক উন্মোচন সময় ও পরিসরের নিরিখে। 'প্লেগ' ও 'কোভিড-১৯' কে একটা ফ্রেমে আনা, যেখানে মনে হচ্ছে সময়টা বোধহয় বন্ধই হয়ে আছে। কেননা চিত্রটা প্রায় একই। কেউ কাউকে ওভারল্যাপিং করতে পারছে না। আর পরিসর হয়তো সংকীর্ণতা ছাড়িয়ে ব্যাপ্ত হয়েছে। ভালো। লিটল-ম্যাগাজিনের কথা এসেছে, নিজস্ব। সার্বিক অবস্থান নিয়ে সামান্য কিছু কথা (হ্যাঁ, ব্যক্তি দৃষ্টিভঙ্গিতেই) থাকলে ভালো হতো। সব মিলিয়ে ভালো লাগল। ভালো থেকো।

    ReplyDelete
  3. পেরতে চাইছ।সময় তো একইসঙ্গে গতিময় ও গতিহীনও বটে। একই বৃত্তের মধ্যে ঘুরছি আমরা। প্লেগ এসে মিশে যাচ্ছে কোভিডে। পেরচ্ছি এবং পেরচ্ছি না। একইসঙ্গে ঘটছে দুটোই। চমৎকার লিখেছ।

    ReplyDelete

Post a Comment

Previous Post Next Post