পেশায় নির্মাণ শ্রমিক। টাটানগরে রাজমিস্ত্রি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। লকডাউনে আটকে পড়েছিলেন সেখানেই।  অনেক চেষ্টায় অবশেষে ফিরে আসেন নিজ গ্রামে।

যেন একটা দুঃস্বপ্ন দেখে উঠলাম

খাইরুল ইসলাম

 

আমি খাইরুল ইসলাম। বাড়ি মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কা থানার  কুলিগ্রাম। পেশায় রাজমিস্ত্রী।

এখানে নিয়মিত কাজ না পাওয়ায় কাজে গিয়েছিলাম ভিনরাজ্যে, ঝাড়খণ্ডের জামশেদপুর টাটানগরে। রাজমিস্ত্রীর লেবার খাটতাম। বাড়িতে অভাব ছিল। ভিনরাজ্যে গিয়ে নিয়মিত কাজ পেলে দুটো পয়সার মুখ দেখতে পাব এই আশায় আমার মতো অনেকেই আমাদের গ্রাম থেকে ভিনরাজ্যে যায়। আমরা জনা পঁচিশেক লোক একসঙ্গে গিয়েছিলাম। যেখানে কাজ করতাম সেখানেই থাকতাম একটা টিনের চালাতে, সবাই একসঙ্গে। নিজেরাই রান্না করতাম। সারাদিন কাজেই থাকতাম, টিভি রেডিও বিশেষ কিছু ছিল না, ফলে খবরাখবর বিশেষ কিছু পেতাম না। বাইরে বাজারে গেলে কিংবা বাড়িতে ফোন করলে টুকটাক খবর জানতে পারতাম।

করোনা করোনা একটা আওয়াজ শুনেছিলাম কিন্তু বিশেষ কিছু জানতাম না। আমাদের যাওয়া দিন পনেরো হয়েছে এমন সময় হঠাৎই রাত আটটায় লকডাউন ঘোষণা হল। বাজারে একটা চায়ের দোকানে টিভিতে খবর শুনলাম, ভাবলাম একুশ দিন আর এমনকী, কোনো রকমে কাটিয়ে দেব। তারপর তো আবার কাজ শুরু হবে। কিছু টাকা নিয়ে ঈদের আগে বাড়ি ফিরব। কিন্তু যত দিন যেতে লাগলো পরিস্থিতি জটিল হতে থাকল। শেষমেশ বুঝলাম খুব তাড়াতাড়ি কাজ শুরু হবে না। বাড়ি ফিরে যাওয়াই ভালো।

কিন্তু বাড়ি ফেরার চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝলাম লকডাউন আসলে কী! অজানা বিভূঁইয়ে আটকে পড়েছি আমরা। প্রথম দিকে কাছে যে টাকা ছিল তা দিয়ে কয়েক দিন কাটল, লোকাল কিছু সরকারি লোক আশ্বাস দিত বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করে দেবে, তারপর আর দেখা পাওয়া যেত না, এদিকে টাকাও শেষ হয়ে যাচ্ছে, খাব কী? লোকজনও কিছু সাহায্য করে না, আর করবেই বা কীভাবে, তাদেরও তো একই অবস্থা। গ্রামের এলাকার রাজনৈতিক নেতাদের বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করে দেওয়ার অনুরোধ করতে তারা বলল পাস এর ব্যবস্থা করে দেবে কিন্তু নিজ খরচে আসতে হবে। ট্রেন নেই, অন্যান্য যোগাযোগও বন্ধ, কী করব, টাকা ফুরিয়ে গেলে বাড়ির লোকজন টাকা পাঠাত, তাতে একবেলা আধপেটা খেয়ে চালাতাম। তারপর অনেক খোঁজাখুঁজি করে একটা বাসের ব্যবস্থা করা গেল। পঁচিশ জন লোক, পঞ্চাশ হাজার টাকা ভাড়া। বাড়ির লোকজন কেউ গয়না বন্ধক রেখে, কেউ ঘটিবাটি বেচে টাকা জোগাড় করে পাঠালো। শেষমেশ আমরা বাড়ি পৌঁছলাম।

যে বাসে ফিরেছি

এখানকার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরীক্ষা করিয়ে দু-সপ্তাহ হোম কোয়ারেন্টিনে ছিলাম। পরিবারের সাথে ঈদ কাটালাম। যেন একটা দুঃস্বপ্ন দেখে উঠলাম। অনেকে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করছে— কি রে আর যাবি? আমি কি আর বলব, যেতে তো হবেই, এখানে কাজ না পেলে আবার যাবো। পেট তো বাঁচাতে হবে? তবে সরকার কী আমাদের কথা একটু ভাবতে পারত না, একটু পরিকল্পনা আর মানবিকতার অভাব কী কোনো দিনই মিটবে না?

অনুলিখন: টিম রেহেল [২৮ মে, ২০২০]



Post a Comment from facebook

1 Comments

  1. আবারও রেহেল-টিম কে ভালোবাসা। খুব সুন্দরভাবে তুলে আনা হয়েছে এই শ্রমিকটির মনের কথা। যাদের নিয়ে গোটা দেশ তোলপাড়। আমরা অনেকেই অনেক স্ট্যাটাস মেরেছি ফেসবুকে। তাদের কথা এত সরাসরি নিয়ে আসায়, খুব ভালো লাগছে। এই যে বাধ্যবাধকতার কথা উনি বলছেন-- যেতে তো হবেই আবার। এতে মুহূর্তে ওপেন হয়ে যাচ্ছে, একটা রাজ্যের আর একটা ফেডারেল চরিত্রের রাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থা আর অবস্থান।

    ReplyDelete

Post a Comment

Previous Post Next Post