সংগীত সাধক, ফকির, দার্শনিক।  তাঁর হাতে কথা বলে দোতারা।  লালন তাঁর হৃদয়ে, আর রবীন্দ্রনাথও। শান্তিনিকেতনে শান্তিদেব ঘোষের কাছে শিখেছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত আর বাউলের গুরু বাবা আজহার ফকির। প্রকৃত মানবপ্রেমী মনসুর ফকিরের পরিচিতি আজ বাংলার ঘরে ঘরে।

মন-সুর-কথা 

মনসুর ফকির


১. খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায় ... 

পৃথিবীটাকেই খাঁচা বানিয়ে ফেললে তুমি আর অচিন পাখি কে ধরবে ক্যামনে গো... চিনবে ক্যামনে... মনই নেই আবার মনোবেড়ি পাবে কোথায়... বরং মনেই বেড়ি পরে নিচ্ছো সব... সন্দেহ... ভয়... লোভ... এতো বেড়ি পরিয়ে দিচ্ছ মনের গায়ে শিকলের ঝনঝন ছাড়া কোনো কিছু নেই... মন আর কৃষ্ণের বাঁশিও শোনে না... নবীর আজানও না। মনের মধ্যে লকডাউন। এখন নয় এ চলছে অনেকদিন থেকেই আজ করোনা তোমাদের জীবনেও নিয়ে এল চারিদিকে বেড়ি... অথচ দ্যাখো লকডাউন আমার এখানে নেই। কেন, থাকবেই বা কেন বলো ? আমার যে লক করে রাখার কিছু নেই আবার ডাউন করারও কিছু নেই গো হা হা হা... আমার তো ফকিরের দরাজ দরবার... দরজাই নেই তবু যাওয়া আসা নিয়ে বসে থাকি। কত লোক আসে যায় হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রীষ্টান... এ যে মন্দির মসজিদ নয় গো এ হল আমার আশ্রম আমার মাজার... সবার অধিকার আছে... সমান অধিকার আছে... ভালোবাসার অধিকার আছে... কারোর কাছেই কোনো বাধা নেই... আমারও না নেই... যে কোনও দিক দিয়ে ছুটে আসতে পারো আমার  হৃদয় জোড়া উঠোনে দূরত্ব নেই... সবাই নিকট আত্মীয়...  এখন রোগের ভয়ে দূরে দূরে থাকার কথা বলছে... হায়রে কপাল আমার... দূরে দূরে থাকাটাই বরং একটা দূরারোগ্য রোগ... নিজের মত থাকাটাই সংকীর্ণতা... একটা ব্যাধি... কি যে রোগ এল... আরে “অতিথি দেব ভবঃ” এটাই ভারতবর্ষের নিজের কথা... ভারতবর্ষের প্রধান মাহাত্ম্য... কখন সোনার গৌর অতিথি সেজে চলে আসবে, আমরা পরম যত্নে তাকে সেবা করব আর আবদার করব— 

              “ছেড়ে দিলে সোনার গৌর আর তো পাব না, ছেড়ে দেব না...” 


২. আমি সবার পিছনে থাকব 

না না কিছুই থাকবে না এসব দেখে নিও। না কোনো অনুষ্ঠান নেই এখন... কাছাকাছি থাকা যাবে না,  দল বেঁধে থাকা যাবে না হা হা হা আরে পাগল তার মানে কি যোগাযোগ বন্ধ রাখা যায় কোনও দিন... এ তো ভক্তের সাথে ভগবানের অন্তরের সুড়ঙ্গপথ,  মাঝে মাঝে ভক্তকুল ঠিক চলে আসে আমার মাজারে... পাঁচ সাত জন করে এসে হাজির হয় গান হয়, বাজনা হয়,  আমি রান্না করি সেবা করি ভক্তের আহা ওরা ভগবানের থেকেও বড় যে... ১০০ বছর পেরিয়ে মহামারী এসেছে সারা পৃথিবী জুড়ে মড়ক লেগেছে দ্যাখো আমেরিকায়, ইউরোপে মরে গেল হাজার হাজার লোক শুনছি... দেখছি... ভারতেও শুরু হয়েছে অথচ আমার গ্রামে নেই গো... এখানে চাষাভুষো মানুষ সারাদিন রোদে জলে মাঠের হাড়ভাঙ্গা কাজ সেরে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা হাজির হয় ফকির সাহেবের মাজারে... একসাথে গান হয়, লালনের সাঁইয়ের গান, ভজন সুফী একতারা দোতারা খমক খোল ঢোল করতাল হাহা হিন্দু মুসলিম একসাথে তালে তালে মাথা দোলায় এটাই আমার ভারতবর্ষ... একসাথে মানুষ এলেই সৎসঙ্গ হয়, সঙ্গ আবার কাউকে আলাদা করে দেয় না কি? উল্টে সবাইকে এক করে দেয়... ভাবতে শেখায় আমরা মানুষ আমাদের দুটো ভাগ নারী পুরুষ... আর কোনো ভাগ নেই, ভেদাভেদ নেই। দ্যাখো গড, আল্লা, ভগবান, কৃষ্ণ, গীতা, কোরান, বাইবেল কেউ কাউকে আলাদা হতে বলে না সবাই তো মানুষের হুঁশ জাগাবার রাস্তা দেখায় গো... সবাই পাপ ধূলিসাৎ হওয়ার কথা বলে... এই যে করোনা... এই যে চীনের সাথে যুদ্ধ এগুলো সবই নিমিত্ত... এত ভেদ এনে ফেলছে মানুষ নিজের ভিতরে বাইরে সারা পৃথিবীব্যাপী এটাই আসল মহামারী এখন... তবু দেখো মানুষই থাকবে বাকী সব শেষ হয়ে যাবে... আমার তো আর গদি হারাবার ভয় নেই গো... যে, এ আমার লোক ও তোমার লোক এসব বিচার করব... খুঁজে খুঁজে বেছে বেছে ত্রান দেব...  হা হা হা হা...  এই দ্যাখো প্রায় চারশো জনকে আশেপাশের গ্রামে এই দাসপাড়া, মাহিষ্যপাড়া, গোরভাঙ্গাতে ত্রান ব্যাবস্থা করেছি নিজে ভিক্ষার জোরে ভক্ত, পঞ্চায়েত সবার সাহায্যে... আমি ফকির আমার কিছু নেই... পাওয়ার নেই... হারাবার নেই ... ভয়ও নেই... আমি সবার... আবার সবাই আমার... আমি সবাইকে ডাকতে পারি...  

                        "আমি সবার পিছনে থাকব

                         আর মনে মনে মাকে ডাকব

                         কারো কাজে বাধা হলে সাজা দিও যত খুশি

                         আমায় একটু জায়গা দাও মায়ের মন্দিরে বসি"

 

৩. এক মন যার সেই যেতে পারে ...      

ভক্ত যে কি জিনিস যে না পড়েছে ভক্তের চক্করে সে আর বুঝবে কি গো...  এই যে তিন তিনটে গ্রামের লোকের কাছে মাসের চাল এটা ওটা  পৌঁছে দেওয়া হল আমারই কিছু নেই কিন্তু যেটা আছে সেটা হল একটা মন। মন ছাড়া কিছু নেই গো... তুমি চাইলেই পারবে... চাইতে হবে ঠিক করে... মন থেকে... এ কি সরকারের মাসিক ভাতা? সারা বাংলায় প্রায় দু লক্ষ তিরিশ হাজার শিল্পী আছে, পাঁচশো টাকা তিনশো টাকা হাজার টাকা দিয়ে দিলাম আর ফলাও করে বললাম হা হা হা শিল্পীকে সাহায্য... আরে ধুর... মন কোথায় মন... মন চাই... মন ছাড়া ভগবান ভক্তের আর কি মাধ্যম আছে গো... ভক্তিসুধা ছাড়া আর কি-ই বা পাওনা আছে ভগবানের আর গুরুদেবের... আর তার জন্য একটা মন চাই... আসলে এ এক অন্ধকার সময়... তোমরা বুঝছো না হে... মানুষের থেকে মন কেড়ে নিচ্ছে যত দুশমন... দূষিত মন যাদের… মানব মন থেকে মানবতা মুছে দিতে চাইছে ... এই এখন করোনা শুধু নয় গো... সেই কবে থেকে শুরু হয়েছে তোমার মনকে বিষিয়ে দেওয়া... জনগণকে ব্যস্ত রেখে দিচ্ছে এক একটা ঘটনা... এই কাশ্মীর... এই ১৭৭ ধারা... এই হিন্দু মুসলিম ভাগাভাগি... এখন দ্যাখো চীনের সাথে তরজা... আহা আমাদের ছেলেগুলো বলি হয়ে গেল... এই শুনলাম ২০ টা এই শুনি ৪০ টা তাজা প্রাণ আমার দেশের ছেলে চলে গেল... কে দাম দেবে... বলো... কার ভুল কে জীবন দিয়ে দাম চোকাচ্ছে... আমরা ফকির বলে আমাদের কি জোর নেই... আমরাও পারি ঢাক, ঢোল, কাঁসি, একতারা, দোতারা নিয়ে বেরিয়ে পরতে দ্যাখো তোমাদের এত ভেদ ধর্মের প্রচারের বিরুদ্ধে আমাদের দোতারা তখন এ কে ফর্টি সেভেনের মত ঝলসে উঠবে... তোমরা পারবে না রুখতে আমাদের, তোমরা ভুলে যাচ্ছো আমার ভারতবর্ষের ইতিহাস... মানবতা ছাড়া আর কিছু টেঁকেনি এদেশের মাটিতে... এই লকডাউন এই করোনা এই হিন্দু মুসলমান এই চীন পাকিস্তান... এসব আতঙ্ক দিয়ে এসব ভয় দিয়ে চিরকাল মানুষকে মানবতাকে মনকে আটকে রাখা যায় না... মানুষের জয় হবেই... ভালোবাসার জয় হবেই...                 

                                                       হবে হবে ... হবে জয়

                                                      প্রতিবাদ জেগেছে আজ অন্ধরাতে

                                                      নতুন সূর্য ওঠার এই তো সময়

                                                      জয় বাংলা... বাংলার জয় ...

                                                    জয় ভারতবর্ষের জয় ...

 

                                     হবে ... হবে... জয়

                                     বাউল ফকির জেগেছে অন্ধরাতে

                                     নতুন সূর্য ওঠার এই তো সময় 


              জয় বাংলা... বাংলার জয় ...

                                     জয় ভারতবর্ষের জয় ...

হবেই একদিন... যারা কলকাতা থেকে এত কথা বলতে আসে... আমার ছবি তুলতে আসে... আর তারপর কত অভিনয়... আহা ফকির সাহেব... ওহো ফকির সাহেব... ভাবে কিছুই বুঝি না... এই লক ডাউনে কয়জন খোঁজ নিয়েছে ফকির সাহেব কি খেলো... কি ভাবে থাকলো কেউ কেউ আবার কানে দুল পরে আসে বড় বড় চুল নিয়ে আহা কি অভিনয় সব কি খুশি করার চেষ্টা... আমি ওদের দেখি মনে মনে হাসি... হায়রে মানুষ... মন নিয়ে তোরা ব্যবসা করিস... মনই নেই বরং শিয়রে শমন... হাজার হাজার বছর পেরিয়ে এসেছে ভারতবর্ষ... শক, হুন,পাঠান, মোগল... সব পার করে দিয়েছে সোনার ভারত। আমরা তার সন্তান... আমরা এখন আছি... ওই দ্যাখো সুফীগান... মানুষকে ডাকছে... মন চাইছে মানুষের... ওই দ্যাখো নিমাই সন্ন্যাসী হরিনামে ডাকছে মানুষকে... মনে মনে বিলিয়ে দিচ্ছে প্রেম... মন দাও হে মানুষ মন খুলে দাও মানবতার কাছে... ওই দ্যাখো ভবা পাগলা বলছে...

 

                                   আমার নিতাই চাঁদের বাজারে

                                   আমার গৌর চাঁদের দরবারে

এক মন যার সেইই যেতে পারে

ওরে দু-মন হলে পরবি ফাঁদে 

পারবি না পাড়ে যেতে 

একমন যার সেইইই যেতে পারে 

 

কাঠুরিয়া মানিক চেনে না

চিনির বলদ বইলো চিনির স্বাদ তো পেল না

যেমন স্বর্ণকারে সোনা চেনে

তবু নেয় সে ভাই পরখ করে

 

এক মন যার সেইই যেতে পারে

হরিবোল ... হরিবোল...

ওরে দু মন হলে পরবি ফাঁদে 

পারবি না পারে যেতে 

এক মন যার সেই যেতে পারে

 

হরিবোল... হরিবোল...

জয়গুরু... জয়গুরু... 

জয় ভারতমাতার জয়...

বন্দেমাতরম...  

 অনুলিখন: টিম রেহেল [১৮ জুন, ২০২০]



Post a Comment from facebook

2 Comments

  1. আহা! কী বলা! আমরা সাধারণ মানুষ ভাবতে পারি না, এমন চিন্তা-ভাবনা। অথচ এই সাধকের সমাজ-রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে কথা কী স্পষ্ট ও সাবলীল। এই কাজটির জন্য টিম রেহেল-কে আমার অনেক ভালোবাসা। পড়ার পর মনের অনেক ক্লেদ সরে যায়। সাধনার ব্যবহারিক ক্ষেত্রগুলো চিনতে সহায়তা করে। একজন মানুষ ও তার রাষ্ট্রের এই মুহূর্তের কর্তব্য-কর্ম নিয়ে তাঁর বক্তব্য এমন সমর্থনযোগ্য যে নিজেকে একাত্ম করা যায়। তাঁর দীর্ঘ জীবন কামনা করি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. চতুর্দিকে শুধু মুখোশ আর বাজার। বাজার গিলে খাচ্ছে মন। তার থেকে বহুদূরের বাসিন্দা আপনি। সুস্থ থাকুন আর মনের মরূদ্যানে শ্যামল ছায়া দিতে থাকুন পথভ্রষ্ট আমাদেরকে।

      Delete

Post a Comment

Previous Post Next Post