সিঙ্গাপুরের ট্যান টক সেঙ সরকারি হাসপাতালে এপিডেমিওলজিস্ট। বাংলার মানুষ তাঁকে চেনে কবি হিসাবে।  কবিতা ও সাহিত্যে তাঁর অবাধ যাতায়াত। অন্যরকম কবিতা প্রয়াসী। লেখেন সাবলীল গদ্য।

করোনাভাইরাস মোকাবিলার পরিকাঠামো নির্মাণে সুরক্ষিত করা হোক প্রতিটি কর্মীর মানসিক স্বাস্থ্যও 

সঞ্চালিকা আচার্য

 

"পৃথিবীর এইসব গল্প বেঁচে র’বে চিরকাল" —জীবনানন্দ দাশ  

চব্বিশে মে আবার দেখা হলো আইভির সঙ্গে। আজ নিয়ে ঠিক চারমাস অতিক্রান্ত হয়েছে সিঙ্গাপুরে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের, দু'মাস হলো আমি সম্পূর্ণ গৃহবন্দী। অফিসের কাজ, ক্লাস, বাজার— সবই চলছে বাড়ি থেকে, অনলাইনে, হোঁচট খেতে খেতে। কোভিড-১৯ আমাকে হতচকিত করেছে ঠিকই, কিন্তু বিমূঢ় করেনি। গত কয়েক বছরের মধ্যেই ঝড়ের মতো বয়ে যাওয়া সার্স, মার্স, ও সোয়াইন ফ্লু একটা অতিমারির সম্ভাবনার দিকেই ইঙ্গিত করছিলো, কিন্তু সে যে এতো তাড়াতাড়ি চলে আসবে, সেটা বোধহয় কেউ ভাবেনি। বৈজ্ঞানিকদের সাবধানবাণী কোনো রাষ্ট্রই যে গুরুত্ব সহকারে নেয়নি, সেটা এই প্যানডেমিক খুব স্পষ্ট করে দিয়েছে। তাই হাতে গোনা দু-তিনটি দেশ বাদ দিলে আর সকলেই হিমশিম খাচ্ছে এই বিপদ সামাল দিতে। তবে একটি সদর্থক দিক হলো এই কোভিড-১৯ এর আমলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান ও গবেষণা বিষয়ে আগ্রহ মাথা চাড়া দিয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রতিনিয়ত অভিযোজিত না হতে পারলে টিকে থাকা যাবে না, এই কথাটা এখন শিশুরাও বুঝে গ্যাছে। সিঙ্গাপুরের একটি সরকারি হাসপাতাল ট্যান টক সেঙ-এ আমি এপিডেমিওলজিস্ট; মহামারী চলাকালীন এই হাসপাতালের চিকিৎসক-বৈজ্ঞানিকরা সার্স-কোভ-২ নিয়ে যে গবেষণাগুলো করছেন আমার ওপর দায়িত্ত্ব এলো সেইসব গবেষণাপত্রের রিভিউ ও প্রয়োজনমত এডিট করা, এবং কিছু ক্ষেত্রে ডেটা অ্যানালিসিস করা। করোনাভাইরাস আরো অনেকের মতোই আমার কাছেও নতুন, তাই পড়াশোনা করতে হচ্ছে প্রচুর। প্রায় প্রতিদিনই নতুন কিছু জানছি, শিখছি। সঙ্গে আছে প্রায় বিনা-প্রস্তুতিতে জুমে ক্লাস পড়াবার আশ্চর্য অভিজ্ঞতা, মনে হয় দেওয়ালের সঙ্গে কথা বলছি। র‍্যান্ডমলি পাল্টাতে থাকা ছাত্রছাত্রীদের চোখ ও সেই চোখে থাকা জিজ্ঞাসা কিংবা ক্লান্তি কোনটারই আভাস পাওয়া যায় না। প্রত্যেকেই যেন পৃথক দ্বীপের মতো এই অনলাইন ক্লাসরুমে। এভাবেই চলতে চলতে করোনাভাইরাসের হাত ধরে আসা দুর্যোগের আকস্মিকতা কিছুটা সামলে নিয়ে বাইরের দিকে তাকাতেই দেখা হলো আইভির সঙ্গে।  

আইভি চিয়া, আমার পাশের ব্লকের প্রতিবেশী, কিছুদিন হলো বন্ধুত্ব হয়েছে। চিনের চেংদু প্রদেশ থেকে কর্মসূত্রে এসেছে সিঙ্গাপুরে, ন্যাশনাল সেন্টার ফর ইনফেকসাস ডিজিজ নামক সরকারী হাসপাতালের জুনিয়র রেসিডেন্ট। অর্থাৎ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র চিকিৎসক এখনো হয়নি, হওয়ার লক্ষ্যে এগোচ্ছে, প্রত্যেক তিনমাসে ডিপার্টমেন্ট বদলে বদলে ট্রেনিং চলছে। বত্রিশ বছর বয়সী আইভি চিন থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করে ইন্টার্নশিপ করতে করতেই বিয়ে করে দীর্ঘদিনের প্রেমিককে। তারপর বেশ কিছুবছর কর্মজগত থেকে দূরে। মা হয়েছে ইতিমধ্যে। তারপরই সিঙ্গাপুরে এই চাকরি নিয়ে চলে আসা। বর্তমানে সে বিবাহ-বিচ্ছিন্না, পাঁচ বছর বয়সী সন্তান আর ইন্দোনেশিয়ান কাজের দিদিকে নিয়ে একা থাকে। কথায় কথায় জানালো ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের এক সন্ধেবেলায় ওরা তখন রাতের খাবার খাওয়ার আগে একটু হাঁটছে, তখনই হাসপাতাল থেকে মেডিক্যাল অফিসারের ফোনটা আসে। পরেরদিন সকাল সাতটায় রিপোর্ট করতে হবে, আউটব্রেক ইমারজেন্সি। ডাক পেয়েই খুব উত্তেজিত বোধ করে আইভি, এই তো ডাক্তারি পড়া সার্থক হতে চলেছে। এই বিপর্যয়ের মোকাবিলায় অগ্রজ চিকিৎসক ও নার্সদের সঙ্গে সেও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়বে। তখনও মেয়েটা বোঝেনি কাজটা অতটা সহজ নয়।

উচ্ছ্বাস থিতিয়ে আশঙ্কা বাড়তে থাকে যখন রোজ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় আসা রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে, আর তারই সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাল্টাতে থাকে পেশেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রটোকল, নির্দেশিকা। প্রতিদিন নতুন তথ্যের অভিঘাত, একদিন অন্তর দিনে আটঘণ্টা করে পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) পরে কাজ করা, তাও এই আবছা বাতাবরণে অসম্ভব মানসিক চাপের মধ্যে, বিধ্বস্ত করতে থাকে ওকে। সারাদিন কাজের পর বাড়ি ফিরে বাচ্চাটির সঙ্গেও সময় কাটায় ভয়ে ভয়ে, যদি ভুল করে কখনো কোথাও ভাইরাসটির ছোঁওয়া লেগে যায়, তবে! যদি হাত ধোওয়াতে ফাঁক থাকে, পিপিই ঠিকমতো পরেছিল তো, রোগীর সংস্পর্শে এসে থাকে যদি অন্যমনস্কতায়! উপরন্তু বয়স্ক বাবা দীর্ঘদিন হাঁপানিতে ভুগছেন, তাঁকে নিয়ে মা আছেন একা, বোন লন্ডনের একটি হাসপাতালে নার্স, সেখানে কদিন আগেই একটি সিঙ্গাপুরি চাইনিজ ছেলে বর্ণবিদ্বেষী আক্রমণের শিকার, এসব ওকে তোলপাড় করতে থাকে ভেতর ভেতর। মার্চের মাঝামাঝি যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ কে অতিমারি ঘোষণা করলো, যখন আমি ঘাড় গুঁজে একের পর এক গবেষণাপত্রের খসড়া (রিসার্চ প্রোটোকল) রিভিউ করে চলেছি, ততদিনে আইভি টানা আটদিন বিরামহীন দশ ঘণ্টা করে “ডিউটি” করতে করতে পুরোপুরি ভেঙে পড়ে, যাকে পোশাকি কথায় “বার্ন আউট” বলা হয়। কিন্তু আশাপ্রদভাবে ততদিনে সংলগ্ন ট্যান টক সেং হাসপাতালের সাইকিয়াট্রি বিভাগে খুলে গ্যাছে সম্মুখসমরে থাকা স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং মনো-সামাজিক সহায়তা প্রদানের জন্য বিশেষ কেন্দ্র। এখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে যে আইভি, সে আজ ভীতি, অনিয়শ্চয়তা ও আশঙ্কাকে জয় করে নিজেই এখন তার সহকর্মীদের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে সহমর্মিতার হাত।


ভেবে লজ্জিত হলাম যে এই চারমাসে একবারও ওদের কথা মনে পড়েনি, খোঁজ খবর কিছুই নেওয়া হয়নি। আগে দেখা হলেই আলিঙ্গন করে অভ্যর্থনা জানানো হতো, এখন হাত ধরাও গেলো না। উপরন্তু ভয়ে আশঙ্কায় বেশ কিছুটা দূরে (সম্ভবত ছয় ফুটের বেশি, কারণ দুজনেই জানি ছয় ফুট কোনও ম্যাজিক নম্বর নয়) দাঁড়িয়ে কথা বলছি। আইভি যখন বলছে ওর বাচ্চাটা স্কুলে না যেতে পেরে, বাইরে খেলতে না বেরোতে পেরে, মা-কে বেশিরভাগ সময়েই কাছে না পেয়ে কেমন প্রচণ্ড ঘ্যানঘেনে হয়ে ছিল, আর তাকে পর্যাপ্ত সময় না দিতে পারার জন্য অসম্ভব কর্মব্যস্ততার মধ্যেও নিজের মনের মধ্যে উঁকি দিয়েছে অপরাধবোধ, তখন মনে মনে আমি লজ্জায় প্রায় মাটি ছুঁয়ে ফেলেছি। যে সময়টায় বন্ধুর সবথেকে বেশি প্রয়োজন, তখনই তো পাশে থাকিনি। ওর সঙ্গে কথা বলে জানলাম ফ্রন্টলাইনে কাজ করা অনেকেই নিত্যনতুন পলিসির সঙ্গে মানিয়ে নিতে গিয়ে বিপর্যস্ত বোধ করছে। এই ভাইরাসটি সম্পর্কে যে এখনও বিপুল পরিমাণ অজানা তথ্য রয়ে গেছে, সেটা স্বীকার করতে আমাদের অনেক দেরি হয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠানকে এতদিন ভরসা করতাম, বারবার তাদের বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য সকলকেই হতবাক করেছে। এইটুকু সকলেই বুঝে গেছি যে প্রশাসনিক সহায়তা যাই থাকুক না থাকুক, নিজে সচেতন হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। বাইরে যেতে হলে সঠিক মাস্ক (অন্তত ৩-লেয়ার যুক্ত) ব্যবহার, শারীরিক দূরত্ব যতটা সম্ভব বজায় রাখা, এবং বারবার ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধোওয়া— এই তিনটি কাজ বাধ্যতামূলক রিচ্যুয়াল করে তোলা ছাড়া পথ নেই। সঙ্গে অতিপ্রয়োজনীয় হলো গুজব এড়িয়ে চলা, যেকোনো খবরের সত্যতা যাচাই করে তবেই বিশ্বাস করা, মন আনন্দে থাকে এমন কিছু কাজে যুক্ত থাকা এবং অন্যান্যদের প্রতি মানবিক আচরণ।             

আইভির থেকে শিখলাম একটি শব্দবন্ধ 'কমপ্যাশন ফেটিগ'। দীর্ঘসময় ধরে সেবাকর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে শারীরিক ক্লান্তির পাশাপাশি দেখা যায় একরকম মানসিক স্থৈর্যচ্যুতি। রোগব্যাধিজনিত অসম্ভব যন্ত্রনার নিরবচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতা হতে হতে সমবেদনা কমে যায়. কয়েকটি সাধারণ উপসর্গ হলো মেজাজ রুক্ষ হয়ে যাওয়া, অন্যকে দোষারোপ, পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া, অস্বাস্থ্যকর খাবার অথবা নেশা দ্রব্যের দিকে ঝোঁক, আত্মীয় বন্ধুদের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া, তীব্র অসহায়তা ও অনিয়শ্চয়তা বোধ করা ইত্যাদি। আইভির মধ্যে এরকমই কিছু লক্ষণ দেখে ডিপার্টমেন্টের একজন সিনিয়র ডাক্তার ওকে নিয়ে যান সাইকিয়াট্রির আপদকালীন বিশেষ কেন্দ্রে। সেখানে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কাউন্সেলিং করে খুব দ্রুত  সে এই মানসিক অবসাদ কাটিয়ে ওঠে। এখন নিজেই অন্যান্য সহকর্মীদের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখে ও সকলের সঙ্গে নিজের অনুভূতিগুলো ভাগ করে নেয় সুযোগ পেলেই। এরই সঙ্গে ওরা কয়েকজন মিলে নিজেদের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে তৈরী করেছে একটি ব্যবহারিক নির্দেশাবলী; যেমন, দীর্ঘসময় পিপিই পরে থাকলে কী কী অসুবিধে হতে পারে, কীভাবে তার সঙ্গে যুঝতে হবে নিজেকে সুরক্ষিত রেখেও, রোগী কিংবা তার পরিবারের সদস্যদের উগ্রতার সম্মুখীন হলে কী করা যায়, সুযোগ পেলেই বিশ্রাম নেওয়ার কথা মনে করিয়ে দেওয়া, অতিরিক্ত স্ট্রেস-জনিত উদ্বেগ ও হতাশার লক্ষণ কী এবং কীভাবে একটু ভালো থাকা যেতে পারে, এরকম কিছু সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে এই ইনফর্মেশন শিটে। শুধু তাই নয়, দ্রুত পাল্টানো পরিস্থিতিতে ওদের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা যুক্ত করে প্রতিনিয়ত আপডেটও করছে। প্রতিটি স্বাস্থ্যকর্মী রোটেশন ডিউটি শুরু করার আগে ও পরে এই তথ্যগুলো তাদের মোবাইল ফোনে পুশ নোটিফিকেশন হিসেবে চলে যায়। ওদের স্ট্যাটিস্টিক্স বলছে এই প্রোগ্রামটি শুরু করার পর থেকে অনেকেই এগিয়ে এসে নিজেদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিচ্ছে ও অবসাদের কথা বলছে। বলা বাহুল্য এটি নিশ্চিতভাবে ফ্রন্টলাইন কর্মীদের মধ্যে সম্ভাব্য ভয় এবং উদ্বেগ দূর করতে সহায়তা করবে। আমাদেরও মনে রাখতে হবে যারা একদম সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে এই বিপদের মোকাবিলা করছে, তারা কোনো পৃথক শক্তির অধিকারী নয়। তাদেরও ক্লান্তি আসে, ভয় হয়, নিজের ও প্রিয়জনদের বিপদের আশঙ্কায় হয় উদ্বেগ। আমাদের সকলের সহমর্মিতা ও সহযোগিতা তাদের ভালো থাকার পথে একান্ত আবশ্যক।  


সিঙ্গাপুর সরকারের পক্ষ থেকে তিনবার করে প্রতিটি নাগরিককে মাস্ক ও স্যানিটাইজার বিলি করা হয়েছে, ব্যাপক হারে টেস্টিং ও ট্রেসিং চলছে, প্রয়োজনীয় পিপিই-র অভাব নেই, আছে ধনী গরীব নির্বিশেষে সকলের জন্য অত্যাধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা, উপরন্তু জনগণ সচেতন। তাই এখানে অন্যান্য বিশেষ কিছু সমস্যা থাকলেও মহামারীর বিস্তৃতি প্রবল হওয়ার সম্ভাবনা কম। তুলনায় এখান থেকে বহু দূরে ডুয়ার্সের ছোট্ট শহর মালবাজারে রয়েছেন আমার বৃদ্ধ অসুস্থ বাবা মা, যেখানে না আছে কোনো আধুনিক চিকিৎসার সুবিধে, না আছে নমুনা পরীক্ষার পর্যাপ্ত পরিকাঠামো। তার ওপর বাজারঘাটে ভিড়, যার সামনে শারীরিক দূরত্বের নির্দেশ পরিহাস ঠেকে। সর্বত্র বেপরোয়া জনতা। সেখানেও বাইরের রাজ্যগুলি থেকে বাড়ি ফিরছেন কর্মীরা। কয়েকজনের শরীরে মিলেছে ভাইরাস, রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্র তো তৈরীই আছে। তার ওপর ভুয়ো তথ্যের ছড়াছড়ি যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। সংবাদ মাধ্যমগুলিও ফুটেজের লোভে তিলকে তাল করে রগরগে হেডলাইন পরিবেশন করে চলেছে। প্রতিটি দেশের সরকারই চাইছে লকডাউন তুলে অর্থনীতিকে সচল করতে, অথচ তার জন্যে প্রয়োজন সকলের সদিচ্ছা ও সহযোগিতা, যার বিপুল অভাব প্রতিটি স্তরেই দুর্ভাগ্যজনকভাবে লক্ষণীয়।  


আর 'হার্ড ইমিউনিটি'-র দোহাই দিয়ে কিছু পণ্ডিত পরামর্শ দিচ্ছেন সবাইকে রাস্তায় নেমে পড়তে। তাদের প্রশ্ন করে দেখবেন “আচ্ছা ভালো কথা, কিন্তু এর ফলে যে বিপুলসংখ্যক মানুষ এক সঙ্গে আক্রান্ত ও অসুস্থ হয়ে স্বাস্থ্য পরিষেবার ওপর ঘোর দুর্যোগ ডেকে আনবে ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে, তাকে সামাল দেওয়ার মতো পরিকাঠামো আছে তো আমাদের”, তখন তাঁরা চুপ। থিওরি ও প্র্যাক্টিক্যালের মধ্যে গুলিয়ে ফেলছেন। আসলে এতো বড়ো মহামারী সামাল দিতে কোনো রাষ্ট্রের যে কর্মপরিকল্পনা থাকে, তার মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি কিছুতেই পড়ে না। এটি একটি বৈজ্ঞানিক ঘটনা। যদি কোনো পপুলেশনে ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ ব্যক্তির শরীরে ভাইরাসের বিরুদ্ধে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে, সে ভাইরাসের পূর্ব-আক্রমনের ফলে হোক কি ভ্যাকসিনের প্রভাবে, তাহলে বাকি ব্যক্তিরা যারা ওই নির্দিষ্ট ভাইরাসে ইমিউন নয়, তারাও সুরক্ষিত থাকতে পারে। একেই বলা হয় হার্ড ইমিউনিটি। যেহেতু কোভিড-১৯-এর চিকিৎসার জন্যে এখনো কোনো নিশ্চিত ওষুধ নেই, বা প্রতিষেধক ভ্যাকসিনও নেই, এবং প্রৌঢ় ও কিছু নির্দিষ্ট রোগে (যেমন ক্যান্সার, এইচআইভি, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদযন্ত্র ও শ্বাসতন্ত্রের অসুখে আক্রান্ত, অঙ্গ প্রতিস্থাপন হয়েছে, ইত্যাদি) আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই ভাইরাস মৃত্যু অবধি ঘটাতে পারে, তাই হার্ড ইমিউনিটিকে মাথায় রেখে সরকারের কোনো পদক্ষেপ নৈতিক নয়। তেমনই জনগণের কোনো বিশৃঙ্খল আচরণও নিছক মূর্খামি। সরকারের তরফ থেকে এখনো অবধি একমাত্র করণীয় হলো ব্যাপকহারে টেস্টিং, ট্রেসিং, পজিটিভ কেসদের বিচ্ছিন্ন করে রাখা, অসুস্থ ব্যক্তির দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, সর্বক্ষেত্রে যাতে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হয় এমনভাবে পরিকাঠামো তৈরী করা, উচ্চমানের গবেষণালব্ধ ফলের ভিত্তিতে পলিসি তৈরী করা, এবং জনগণের কাছে স্পষ্ট নির্দেশিকা পৌঁছে দেওয়া। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের এখন তাদের কর্মচারীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষিত করার ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে।          


অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপরে এই প্যানডেমিকের যে দুর্বিষহ প্রভাব, তাকে সামাল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই মুহূর্তে প্রায় প্রতিটি আক্রান্ত দেশের কাছেই সব থেকে বড়ো চ্যালেঞ্জ হলো আক্রান্ত সংখ্যা কমানো এবং করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য দ্বিতীয় ঢেউকে আটকানো। যথেষ্ট প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও এখনো অবধি ভাইরাস সম্পর্কে গবেষণালব্ধ নিটোল জ্ঞান খুবই সামান্য। তার ওপর কোনোরকম উপসর্গহীন আক্রান্তদের থেকে রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা নিয়ে থেকে যাচ্ছে পুরু ধোঁয়াশা। জানা নেই ঠিক কতসংখ্যক লোক অ্যাসিম্পটোম্যাটিক, তাঁদের শরীরে ভাইরাসের পরিমান কি অসুস্থ রোগীদের থেকে কম, এই ভাইরাসটির গতিপ্রকৃতি কি কোনরকমভাবে আলাদা যারা গুরুতর অসুস্থ হচ্ছেন তাঁদের শরীরে পাওয়া ভাইরাসের থেকে, ঠিক কোন পথে তাঁদের শরীর ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করে তাকে পর্যুদস্ত করছে, তাঁরা কতটা সংক্রামক, তাঁদের এই অতিরিক্ত রোগপ্রতিরোধক্ষমতা কতদিন স্থায়ী, ইত্যাদি ইত্যাদি। অগণিত প্রশ্নের উত্তর ঘাঁটতে ঘাঁটতে কাঁধের ওপর সন্ধে নেমে আসছে। মাথা যেন ফাঁকা হয়ে আসে, ল্যাপটপের স্ক্রিনে ভাসতে থাকা কোনো মেডিক্যাল আর্টিকেলের অক্ষরগুলোর দিকে তাকিয়ে অসাড় বসে থাকি। জানা নেই কতটুকু উন্মোচিত হবে, কতটা সুদূরপ্রসারী এই ক্ষতি। কিন্তু মানবসভ্যতার ইতিহাস বলছে আমরা এইসবকেও পেরিয়ে যাবো একদিন নিশ্চিত। আমাদের কল্পনার থেকেও অধিক দ্রুতবেগে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে যায় পরিবর্তনের সঙ্গে। বিখ্যাত মার্কিনী কবি ও চিকিৎসক William Carlos Williams এর একটি কথা আছে— Time is a storm in which we are all lost. এই দুর্যোগ অতিক্রম করে মানুষ বাঁচতে শিখে নেবে “নিউ নর্মাল”-এ, যতদিন না পরবর্তী দুর্যোগ আবার ঘনিয়ে আসে। সেদিন হয়ত আমরা থাকবো না, তবু জানি এই পৃথিবীর পরবর্তী প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করবে বলে আইভিদের আখ্যান বেঁচে থাকবে চিরকাল।



Post a Comment from facebook

5 Comments

  1. খুব ভালো লেখা। চারপাশের সঙ্গে একজন ফ্রন্ট-লাইনার চরিত্রকে এনে, এবং নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে শেয়ার করার মাধ্যমে ঝরঝরে ভাষায় এই লেখা আমাদের ব্যক্তিগত জানা ও ভাবাকে প্রভাবিত করে। আবার রাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কেও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটা প্যারাগ্রাফ রাখা আছে, যা হয়তো আমাদের অনেকেরই মনের কথা। সময়ানুসারে প্রয়োজনীয় লেখা। খুব ভালো থাকুন।

    ReplyDelete
  2. এরকম কিছু একটাই খুঁজছিলাম। বাবা-মা কেও পড়ালাম এটা। বাবা কলকাতা পুলিশ আর মা স্বাস্থ্য কর্মী, বলছিল রোজ ডিউটিতে মানুষকে এখনো বোঝানো যাচ্ছে না সাবধনতা অবলম্বন কতটা জরুরি।

    ReplyDelete
  3. অসাধারণ লেখা। প্রযুক্তিগত দিকের সাথে মানবিক দিকটিকে যে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে সেটা খুবই উপযুক্ত। We are proud of you. Carry on.

    ReplyDelete
  4. খুব গুছিয়ে লেখা। মরমী দেখা। খুব সহজেই বিষয়ের সঙ্গে মিশে নিজেকে সমৃদ্ধ করলাম। সাইকো সমস্যা এবং সমাধানের প্রসঙ্গটি আমাকে লেখাটির কাছে কৃতজ্ঞ রাখবে।

    ReplyDelete
  5. খুব জরুরী লেখা দিদি

    ReplyDelete

Post a Comment

Previous Post Next Post