ফ্রন্ট লাইনার। কোভিড রোগীদের সেবায় তৎপর। মুর্শিদাবাদ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সিস্টার ইনচার্জ এর গুরুদায়িত্ব সামলান।

সংশয়, দুশ্চিন্তা এবং আগামীর নতুন সুস্থ পৃথিবী

কৃষ্ণা মণ্ডল

 

আমরা সেবিকা, আমরা উচ্চমাধ্যমিকে ৮৫%-৯৫% নম্বর নিয়ে উত্তীর্ণ হবার পর এই পেশায় আসি। কেউ ভালোবেসেই আসি, কেউ বা নিছক চাকরির জন্য আসি। যদিও আমাদের একটাই ধর্ম মানবের সেবা— সে সুস্থ হোক বা অসুস্থ, এবং সে শারীরিক বা মানসিক সবদিক থেকেই তাদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের কর্তব্য।

বর্তমান পরিস্থিতিতে, দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে আমাদের জেলা তথা রাজ্য তথা দেশ, সর্বোপরি সমগ্র বিশ্ব করোনা নামক ভাইরাসের ভয়ে আতঙ্কিত। আর হবে নাই বা কেন? আমেরিকা, ইটালি, ফ্রান্স, ব্রিটেনের পর ভারতও সংক্রমিত হয়ে চলেছে এই কোভিড-১৯ ভাইরাসের দ্বারা।

এই অতিমারির সময় উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রের মানুষের মধ্যে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ভয় দানা বেঁধেছে। প্রতিনিয়ত আতঙ্ক, সংশয়, দুশ্চিন্তা নিয়ে মানুষ দিন যাপন করছে। আমরা তথা সেবিকাগণও তার ব্যতিক্রম নই। আমাদের দায়িত্ব সকলের মনের ও শরীরের খবর রাখার, কিন্তু আমাদের মনের খবর কি কেউ রাখে??? তাই আমি ধন্যবাদ জানাই এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত সকল ব্যক্তিগণকে, তারা সকল সেবিকার মনের কথা জানাবার সুযোগ দিয়েছেন আমার মাধ্যমে। আমি চেষ্টা করব সবার কথা তুলে ধরার। এই পরিস্থিতিতে আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, পরিবারের দায়িত্ব সরিয়ে রেখে দিনরাত এক করে কাজ করে চলেছি।

আমাদের মধ্যে যারা Commutity nursing-এর সঙ্গে যুক্ত ANM, PHN, Sr-PHN  & DPHNO। এদের মধ্যে সামনের সারিতে কাজ করতে হয় ANM কে, তারা গ্রাম বা শহরের প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে, প্রতিটি মানুষের সাথে কথা বলে,  তাদের temperature check করে, travel history নিয়ে, health education দিয়ে চেষ্টা করছেন কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করার এবং community transmission prevent করার। এদেরকে supervise করছেন PHN এবং Sr-PHN

এবার আসি indoor অর্থাৎ Hospital-এ। যেখানে suspected and positive রোগী ভর্তি থাকেন এবং চেকআপ করাতে আসেন। এখানে থাকেন— GNM, Sister in charge,  Deputy Nurshing Superintendent (DNS) and Nurshing Superintendent (NS)। এই বিভাগের প্রথম সারিতে রয়েছেন GNM Staff দিদিরা। তারা fever clinic এ রোগীর history, temperature check-up, মেডিসিন দেওয়া  এবং করোনার জন্য swab collection এ হেল্প করে থাকেন।

Indoor এ প্রতিটি রোগীর কাছে গিয়ে বেডশিট চেইঞ্জ করা, Vital sign চেক করা, যার মধ্যে   temperature, BP, respiration, saturation এবং pulse-ও পরে। চা, টিফিন, জল, দুধ থেকে দুপুর এবং রাতের খাবার পর্যন্ত দিতে হয়। রোগীর blood sample collection-ও করতে হয় এছাড়া মেডিসিন, ইনজেকশন, স্যালাইন তো আছেই। এদেরকে সুপারভাইজ করেন Sister in charge, DNS & NS

সব থেকে বড় কথা আমাদের female profession (এখনও পর্যন্ত) তাই আমরা সকলেই নারী।  আমরা যেমন health system এর ভিত, তেমনই  আমাদের প্রত্যেকের নিজস্ব সংসার আছে, তার মেরুদণ্ডও আমরা। আমাদের বাড়িতে কী কী কাজ করতে হয় তা সবাই জানেন।

কাজের প্রসঙ্গ আনলাম এখানে৷ কারণ আমরা কী কী কাজ করি তা না জানলে আমাদের মনের গভীরের যন্ত্রণা বুঝতে পারবেন না। এই রোগ সংক্রমণ প্রতিহত করতে সকল শ্রেণীর মানুষকে প্রথমে social distance maintain করার কথা বলা হচ্ছে। ঘরের বাইরে বেরনো বন্ধ করতে lockdown করা হচ্ছে। ভীত, সন্ত্রস্ত মানুষ কেউ  কেউ বা ঘরেই থাকছেন। কিন্তু আমরা? চাইলেও কি ঘরে থাকতে পারছি? ঘরে সন্তান, পিতা-মাতা, শশুর- শাশুড়ি, ভাই-বোন,  স্বামীকে রেখে বেরোতে হচ্ছে কর্তব্যের খাতিরে শুধু তাই নয় positive  রোগীর কাছাকাছিও যেতে হচ্ছে। দূর থেকে বাঘ-সিংহ দেখে ভয় পাওয়া  আর, বাঘ-সিংহের খাঁচায় ঢুকে কাজ করার ভয় কি এক হতে পারে? তবুও আমরা দাঁতে-দাঁত চেপে, ভয়কে জয় করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। কখনো কখনো breast feed করা দুধের শিশুকে রেখে ওই সেবিকাকে PT care দিতে হচ্ছে।  সে জানে তার শিশুর সংক্রমনের chance থেকেই যায়। তবুও বুকে পাথর চেপে মানসিক যন্ত্রণাকে লুকানোর চেষ্টা করছে সে।

দ্বিতীয়ত, বলা হচ্ছে  self protection নিতে। সাধারণ মানুষ মাস্ক পরেই হাঁপিয়ে উঠছেন। তাই রাস্তা-ঘাটে দেখা যায়  মাস্ক হয় মাথায় নয়তো গলায়,  নয়তো নাকের নীচে। ভাবুন তো আমাদের মেয়েরা PPE মানে Personal Protecting Equipment,  যার মধ্যে cap, mask, goggles, gloves, face shield, shoe-cover,  air proof jacket ইত্যাদি আছে। এইসব পরে ৬ ঘন্টা কীভাবে ডিউটি করে এই তীব্র গরমে! যা পরলে ৩০ মিনিটেই ঘেমে নেয়ে, জামা ভিজে স্নান হয়ে যায়, চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। ওই ৬ ঘন্টা সে জল পিপাসা পেলেও খেতে পারেনা, toilet পেলেও যেতে পারে না। মাঝেমাঝে ওরা নিজেরাই অসুস্থ হয়ে যায়। সীমাহীন যন্ত্রণায়,  নীরবে চোখের জল পড়ে। যেহেতু গত এক সপ্তাহ  আমি নিজেই এই কোভিড হাসপাতালে ডিউটি করেছি। তাই মেয়েদের এই করুণ অবস্থার, আমি অসহায়ের মত সাক্ষী হচ্ছি। ভাগ্যিস রোগীরা মেয়েদের ভয়ার্ত,  ক্লান্ত, অসহায়,  যন্ত্রণা-কাতর মুখগুলো দেখতে পাচ্ছে না। দেখলে হয়তো ওরাও দুঃখিত হত।

Hospital এ আর একটি Department আছে যার নাম CCU। যেখানে Critical PT-র চিকিৎসা হয়।  এখানে রোগীরা ventilation-এ থাকেন। রোগীর শরীরে প্রচুর গয়নাগাটি থাকে,  যেমন  ECG Lid, Channel, Multichannel Monitor, Dialysis, Catheter Suctioning-tube। এখানে  সংক্রমনের chance সর্বাপেক্ষা বেশি। তাও সেবিকারা হাসিমুখে অতন্দ্রপ্রহরী  এখানে, নীরবে  নিভৃতে।

এবার আসি labour-room এ। এখানে প্রসবের সময় পদে-পদে সংক্রমণের ভয়। গর্ভবতী মা যন্ত্রণায় সেবিকার হাত, জামাকাপড় জাপটে ধরে দূরত্ব তো দূরে থাক, amneotic fluid আর blood-এ PPE ভিজে যাওয়ার ভয় থাকে। তবুও মা ও সন্তানকে সুস্থ রাখতে সেবিকারা প্রাণপণ চেষ্টা করে। বর্তমানে ৫% গর্ভবতী মা কোভিড-১৯ positive হয়ে হাসপাতালে আসছেন। ভয় সংশয় নিয়ে হাসিমুখে সেবিকারা সেবা করে যাচ্ছেন। সদ্যোজাতকে নতুন পৃথিবীর আলো দেখানোর জন্য। জেনারেল ওয়ার্ড বিশেষ করে মেডিসিন বিভাগে তো কোন প্রটেকশনই নেই শুধুমাত্র সার্জিক্যাল মাস্ক পরেই রোগীদের সেবা করতে হচ্ছে। তার ওপর ওভার-ক্রাউডেড রোগী। এবং রোগীর আত্মীয়রা ভিড় করে থাকেন প্রায় ঘাড়ের উপর। কে সংক্রমিত আর কে নয় তা বোঝার উপায় নেই। তবুও অন্ধকারে সেবিকারা আলোর দিশা খুঁজে চলেছেন।

তৃতীয়ত, সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে Quarantine-এর কথা বলা হয়েছে সে institutional হোক বা self-ই হোক। কিন্তু কেউ কি একবারও আমাদের কথা ভাবছেন? ইচ্ছা থাকলেও পজিটিভ রোগীর কাছে ডিউটি করার পরও নিজেকে আলাদা রাখতে পারছেন না। কারণ কারো ছোট্টশিশু, দেখার হয়তো লোক নেই, বাড়িতে কোনও কাজের লোকও নেই। কারো বা বাড়িতে অসুস্থ বা বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি। কে দেখবেন তাদের? দিবারাত্র শিশু ও বৃদ্ধদের সংক্রমণের ভয় নিয়েই দিন যাপন করতে হচ্ছে তাদের।

এরপর আসি co-morbidity-র ব্যাপারে। আমরা এতদিনে জেনে গেছি 60 year age, high bp, diabetes,  kidney dieses, heart disease etc থাকলে এবং করোণা সংক্রমণ হলে death rate high। কিন্তু আমাদের মধ্যেও সিক্সটি-ইয়ার-এর কাছাকাছি অনেক সেবিকা আছেন। আছেন অনেক co-morbid condition এর সেবিকারা। তারা সারাক্ষণ ভয়ে কুঞ্চিত হয়ে থাকেন। আর বাড়িতে যে বয়স্ক co-morbid dieses condition এর family member আছেন, তাদের সেবিকারা না বলতে পারছেন, না নিজেকে দূরে  রাখতে পারছেন। না নিজে সহ্য করতে পারছেন। কেউ কেউ হয়ত মানসিক অবসাদেও ডুবে যাচ্ছেন সংশয় আর দোলাচল কাটাতে না পেরে।

অতএব আমরা সেবিকারা জেনেশুনেই আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছি। মৃত্যু শিয়রে অপেক্ষা করছে জেনেও। এত কায়িক পরিশ্রম করেও, মানসিক যন্ত্রণা নিয়েও শান্ত থাকা যায়, কিন্তু যখন দেখি কোভিড-হসপিটালের নাম শুনেই টুকটুক বা টোটো-ওয়ালারা যেতে চাইছে না। বাড়ি ওয়ালারা বাড়িতে থাকতে দিচ্ছেন না, এমনকি কোন গ্রামে ঢুকতে দিচ্ছেন না। তার ওপর রোগীর আত্মীয়দের কটুক্তি। এসব সহ্য করা কি কোন রক্তমাংসের শরীরের পক্ষে সম্ভব? এত ঝুঁকিপূর্ণ এবং বেদনাদায়ক কাজ অন্য কোন পেশাতে আছে কিনা আমার জানা নেই। তবুও আমরা আছি, আমরা থাকবো তোমাদেরই পাশে। তবুও আমরা নারী, মমতাময়ী-নারী স্নেহময়ী-নারী। আমাদের ধর্ম মানুষের সেবা করা। তাই শত যন্ত্রণা, ভয়, সংশয় দুশ্চিন্তা, অভিমান, মনের গভীরে গোপন করেই আমরা হাসিমুখে আনন্দের সঙ্গে আগামীর নতুন সুস্থ পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে ব্রতী হয়েছি, এবং রোগীর সেবা-যত্ন করে সমাজকে সর্বাঙ্গীন সুন্দর করতে চাইছি। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, আগামী নতুন দীপ্ত-সূর্যের আলোর অপেক্ষায় শেষ করলাম।


Post a Comment from facebook

1 Comments

  1. বেশ লাগলো। একদম নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং সঙ্গে এই কাজে যুক্ত নারীদের কথা, যাঁদের তিনি বারবার সেবিকা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। করোনা-ভাইরাস সংক্রান্ত তাঁদের কাজের ভূমিকা, তার অপরিহার্যতার সঙ্গে তুলে এনেছেন তাঁদের ব্যক্তি-জীবনের অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতা। একটা ছবি তুলে ধরেছেন সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার, যার অনেকটাই আমরা জানতাম না। ধন্যবাদ আপনাকে। আপনারা যখন বলছেন- আমরা প্রতিকূলতার মধ্যেও আমাদের কাজ করেই যাবো, তখন আশ্বস্ত হই বৈকি। বিনিময়ে শুধু এটুকুই বলি, আপনারাও পরিবারসহ সকলে ভালো থাকুন।

    ReplyDelete

Post a Comment

Previous Post Next Post