প্রয়োজন ছিল আরও সুসংবদ্ধ পরিকল্পনার
প্রসূন বিশ্বাস
উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষা শেষ করে আমরা পরের দিনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছি। কে কোন ঘরে যাবে, এইসব। আলোচনার শেষ মুহূর্তে, চায়ের কাপটা নামিয়েছি, এমন সময় হেডস্যার বলে পাঠালেন উচ্চ মাধ্যমিকের ষষ্ঠ পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। কারন, "করোনা"। চাপা গুঞ্জনে ভরে উঠল স্টাফরুম - কী হবে এবার? এরকম তো কোনোদিন দেখা যায় নি। পরীক্ষার কী হবে… বাড়ি ফেরার পথে আমারও ভেতর কিছু প্রশ্ন উঁকি দিতে শুরু করে— 'কী হচ্ছে এ সব ? কী হবে এরপর ? সাধারন মানুষের কিভাবে চলবে ? কিছু দিন নাহয় সঞ্চিত অর্থ ও খাদ্যে সকলের চলে যাবে, কিন্তু তার পর কী হবে? আরও একটু পরিকল্পনা করা কি উচিত ছিল না?আগামীতে আমাদের কী পরিকল্পনা গ্রহন করা উচিত?'
' কী' এর Key খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সেইসব মানুষের জায়গায় নিজেকে রাখলে, শুধু মনে হচ্ছিল—
তোমার আছে সুখের ঘড়ি
মস্ত বাড়ি, পয়সা কড়ি
ঘরে খাবার মেলা।
লকডাউনে তাইতো তোমার
বন্দী
বন্দী খেলা।
আমরা যারা দিন আনি খাই,
লেবার কিমবা রিক্সা চালাই,
খাটি
গায়ের বলে,
কাজ না পেলে, বলো তাদের
পেট কী করে চলে?
এতক্ষনে আপনারা বুঝতেই পেরেছেন যে, আমি একজন শিক্ষক। কিন্তু শিক্ষক হিসাবে নয়, রেহেল আমাকে একজন সমাজকর্মী হিসেবে লেখার আহ্বান জানিয়েছে, সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ। স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে আমাদের সংগঠন সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের পাশে থাকতে চেয়েছে বরাবর।
আমি একজন খুবই সাধারন মানুষ তাই আমার চিন্তা ভাবনার বিস্তারও খুবই সাধারন। হঠাৎ করে ডাকা লকডাউন, সত্যি বলতে তালা ঝুলিয়ে চাবি হারিয়ে ফেলার মতো। একশো আটত্রিশ কোটির দেশে আশি শতাংশ যেখানে দিন-আনা দিন-খাওয়া। কাজ বন্ধ, পেট তো না! এই সমস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এগিয়ে এসেছে, তাদের সকলকে আমার ধন্যবাদ। এই করোনা আবহাওয়ায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলিকে অনেক চিন্তা ভাবনা করে এগোতে হয়েছে। কারন সংগঠন তো মানুষ চালায়, যারা বাইরে বেরবে এবং দিনের শেষে ঘরে ফিরে হয়তো বাড়ির সকলের জন্য বিপদ ডেকে আনবে— এই চিন্তা সকলের মনে সবার প্রথমে এসেছে। তাই আমার মনে হয় একশো শতাংশ পরিষেবা কোনো সংগঠনই দিতে পারে নি। বিশেষ করে প্রত্যন্ত গ্রামে পরিষেবা দেওয়া সবটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি । কারন একটাই— ভয়, এবং ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
লকডাউন শুরু হওয়ার প্রথম দিকে আমার এক বন্ধু, তারা কয়েক জন মিলে বেশ ভালোই মানুষের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছিলেন। আপনারা লক্ষ্য করবেন লকডাউন এর প্রথমদিকে ফেসবুক খুললেই শুধুমাত্র ত্রাণ বিলির ছবি। কিছুদিন পর ছবি কমতে থাকলো। এখন তো আর ছবি দেখাই যায় না। তার মানে কি এই লকডাউন এর প্রথম দিকে মানুষের খিদে পেত, এখন আর খিদে পায়না , ব্যাপার টা কি এরকম? না একদমই না, তবে পরিস্থিতি অনেক পাল্টে গেছে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে মানুষ চাইলেও, ভয় মানুষের পাশে মানুষ কে দাঁড়াতে দিচ্ছে না।
আমরা যারা পরিকল্পনা করে, গোছালোভাবে লকডাউন এর পর বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছি, তাদের সামান্য অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি— "গ্রামে ঢোকার মুখে বাঁশ দিয়ে রাস্তা আটকে লেখা - লকডাউন। গ্রামের কিছু পরিচিত ব্যক্তির সাহায্যে যখন তাঁদের হাতে সামান্য কিছু তুলে দিতে সমর্থ হলাম, তখন তাঁদের চোখে মুখে স্বস্তির নিঃশ্বাস। হয়তো আগামী সাত দিন শুধু ভাত খেয়ে থাকতে হবে না। সঙ্গে থাকবে ডাল, আলু সয়াবিন এর তরকারি। সকালে বিকালে থাকবে চিনি, জল, মুড়ি। স্নানের সময় থাকবে সাবান। শুধু একটাই চিন্তা হচ্ছিল, আমরা যা দিলাম তা শেষ হয়ে গেলে কী হবে? আবার শুধু ভাত! হায় ভগবান লকডাউন করার কোনো যন্ত্র কেন এই হতদরিদ্রদের দিলে না, যা দিয়ে তারা তাঁদের খিদে লক ডাউন করতে পারত! "
কিছু দিন আগে ত্রানসামগ্রী বস্তা বন্দি করছিলাম, দূরের একটি গ্রামে নিয়ে যাওয়ার জন্য। হঠাৎ কয়েক জন মহিলা এলেন, সাহায্য চাইতে।বিভিন্ন বাড়ি ঘুরতে ঘুরতে এসেছেন। আমরা যথাসাধ্য তুলে দিলাম তাঁদের হাতে। সাহায্য পেয়ে তাঁরা কেঁদে ফেললেন, বললেন তাঁদের বাড়িতে বহুদিন কোনও খাবার নেই। ভেবে অবাক হলাম , তাঁরা অন্তত দশ কিলোমিটার হেঁটে এসেছেন বহরমপুরে, একটু সাহায্যের জন্য।
এ তো গেল যাঁরা চাইতে পারেন তাঁদের কথা। আমাদের আশেপাশেই অনেকে আছেন যাঁরা খিদেতে মরে যাবেন কিন্তু চাইতে পারবেন না। এ রকমই একজনের কথা বলি।একদিন আলু সয়াবিন ইত্যাদি বস্তাবন্দী করছি,এমন সময় দেখলাম অনেক্ষন থেকেই এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক (বয়স পঞ্চাশ পঞ্চান্ন হবে) , দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের প্যাকিং করা দেখছেন। ওনাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম— কিছু বলবেন। অত্যন্ত বিনম্রভাবে তিনি জানালেন— সকাল থেকে খালি ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন, কিন্তু কোথাও কিচ্ছু পাননি, সত্যি বলতে চাইতে পারেন নি। বাড়িতেও কিছু নেই, যে রান্না করবেন। একপেট খিদে নিয়ে বাড়ির সকলে হয়তো অপেক্ষা করে আছে তাঁর জন্য। বলতে বলতে ভদ্রলোকের গলা ধরে এল। আর কিছু বলতে পারলেন না।
সরকার চাল, গম, আটা
দিলো ঠিকই, কিন্তু একজন মানুষের খিদে শুধু চাল-গমেই তো মিটে যায় না। ভাতের সঙ্গে
লাগে তরকারি, রুটির সঙ্গেও। আর একটু পরিকল্পনা করে ডাল, তেল, সয়াবিন, আলু এটুকুর ব্যবস্থা
করা যেত না? মহামারী কে আয়ত্তে আনতে লক ডাউন প্রয়োজন ছিল নিশ্চিত ভাবে, কিন্তু দরকার
ছিল আরও সুসংবদ্ধ পরিকল্পনার।
একেবারে সহজ কথায় গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বলেছেন। অনেক শুভেচ্ছা।
ReplyDeletePost a Comment