অভিনেতা পরিচালক চিত্রনাট্যকার কৌশিক অবাধে যাতায়াত করেন নাটক থেকে সিনেমায়। অভিনয় ও পরিচালনা করেছেন বহু মঞ্চসফল নাটক। বড়পর্দায় অভিনয়ের পাশাপাশি পরিচালনা করেছেন 'পর্ণমোচী' নামের একটি সিনেমা। স্বপ্ন দেখেন ও দেখান সমাজ বদলের।

একই সূত্রে

কৌশিক কর


.................প্রাণী জগত যার যার প্রজন্ম বিস্তারে আপন আপন পথ ধরে চলেছে। কীট, পতঙ্গ, পশু, পাখি, মানুষ, জলচর, স্থলচর, খেচর সকলেই শুধু নয়, উদ্ভিদ জগতও তার উল্টোদিকের ব্যালান্সের খেলা ও খাদ্য জোগান থেকে খাদ্য খাদক সম্পর্ক  তথা ভারসাম্য রক্ষার এক অসাধারণ দায়িত্ব ও সৃষ্টির ম্যাজিক নিয়ে তার বংশ বিস্তার সহ এই দুনিয়ায় প্রজন্ম বা প্রজনন বিস্তারে হাজির হয়েছে। আর এই সকল সিস্টেমকে চালিত রাখছে ওই পরম সূর্য বা সোলার সিস্টেম। যার জন্যই পুরো দুনিয়ার সকল প্রাণী-উদ্ভিদ-জগত এবং বস্তুজগতের তথা মাটি-জল-সমুদ্র-ধাতু-খনিজ-কাঠ-কয়লা সব একে অপরের কারণ কার্যে জড়িয়ে, মাখামাখি হয়ে, বিরাট একতাল দুনিয়া তৈরী করেছে আর বনবন করে সেই সূর্যের চারিপাশেই পাক খাচ্ছে চৌম্বক শক্তির আকর্ষণ বিকর্ষণে। তাও যেমন যেমন অংশে তার রোদ বা তাপ বা আলো যেমন ভাবে পড়েছে সেই অনুযায়ীই দুনিয়াটা গোল-তেরচা মেরে আলাদা আলাদা জলবায়ু-আবহাওয়া তথা মাটি, বালি, বরফ, জলের ফারাকে আলাদা ভূখন্ড নির্মান করেছে  আর সেই নির্মানের প্রেক্ষিতে মানুষ ছাড়াও বাকি প্রাণী জগত ও উদ্ভিদ জগতেরও ফারাক নির্মান হয়ে গেছে। তাকে নির্ভর করে আলাদা আলাদা ভূখন্ডে আলাদা আলাদা জাত পাত ও ধর্মাচরণের ফারাক তৈরী হয়ে বিশ্বজুড়ে নানা জাতি নানা মত তথা মিল-ভালোবাসা-বন্ধুত্ব-যুদ্ধ-বিগ্রহ-বিবাহ সকলই ঘটে গেছে, ঘটছে ও ঘটবে আগামীতেও।

সুতরাং এই সামান্য আলোচনায় এইটুকু সংক্ষেপে হলেও বিস্তারিত একটা ধারণা তৈরী করে দিতে পারা যাচ্ছে যে দুনিয়ার প্রতিটি ঘটনা, কণা, ইলেক্ট্রন স্রোত, মানুষ, বাঘ, সিংহ, হাতি, ঘোড়া, জলজ, প্রাণীজ, বায়বীয় সবই একই সাথে কারণ কার্যে যুক্ত। কাউকে ফেলে কাউকে নিয়ে আলাদা করে এগোনো যাবে না। যে যার মত করে ভৌগোলিক নিয়মে, পদার্থের মূল সূত্রে, তার বায়োলজিকাল দাবীগুলিকে রেখে, রসায়নের ঘাঁটিগুলি ঘুরে,অংকের হিসাবে, সাহিত্যের মতো করে জীবনের সাথে প্রবেশ ও অপ্রবেশ ও অনুপ্রবেশের খেলা ঘটিয়েছে ও এই ঘটনা ঘটে চলবে এক বৃত্ত পূরণ করে পুণরায় খেলা চালু রাখার ফিজিক্সে বা দৈব নিয়মে। এ খেলায় কেউ বাদ নেই, যা'ই অস্তিত্বশীল— তাই প্রতিক্রিয়াশীল। বাতাসে উপস্থিত গ্যাস হোক বা অদৃশ্য বায়ু সকলেই খেলছে। প্রাণী জগতে সেখানেও খাপে খাপ ব্যালান্সের দেয়া নেয়া করছে। সেই জল-বাতাস-আলোও কারো সরাসরি খাদ্য, তো কারোর জীবন ও যাপন পরিচালক।

তো এই যাপনের মূলেই আছে প্রজনন। নাহলে জগত এক লহমায় স্তব্ধ হয়ে যাবে যদি সকলেই প্রজনন বন্ধ করে দেয়। এই প্রজননের জন্য কে কি না করে। প্রতিটি প্রাণীর প্রজনন ও বেঁচে ওঠার আর বংশ বিস্তারের গল্প আলাদা আলাদা, তার নিজস্ব স্টাইলে। কেউ ডিম পাড়ে, কেউ পাড়ে বাচ্চা কেউ পাড়ে ফল।

গাছের কথাই ধরুন না, গাছ হচ্ছে আদি স্তরের সৃষ্টি। প্রাণী বলাও তো সঙ্গত হবে যেহেতু প্রাণ আছে তার। গমন নেই, কারণ গমনের প্রয়োজন নেই। আত্মনির্ভরশীল যাকে বলে এ হচ্ছে সেই জিনিস। তার সকল প্রয়োজন সে প্রাণীজগতকে দিয়েই মিটিয়ে নেয় ও খাদ্য সরাসরি তৈরী করে নেয় আপন রান্নাঘরে। খানিক হাওয়া, খানিক জল, খানিক রোদ আর খানিক খনিজলবণ, এই কি কারো খাবার হয়? গাছের কিন্তু হয়। সেই খেয়েই সকলের চলে। সকলের সব ভিটামিন, আয়োডিন, মিনারেলস, প্রোটিনের চাহিদা মেটে। কেউ সরাসরি গাছ খেয়ে শক্তি রূপান্তরে বাঁচে, তো কেউ তাদেরকে খেয়ে দ্বিতীয় স্তরে বাঁচে, কেউ কেউ আবার তৃতীয় স্তরে পরজীবি হয়েও বাঁচে। ওই যে বললাম সেই সৌরকথা, সব একই সূত্রে বাঁধা। পালাবে কোথায়?? লোকে বলে পারমানবিক শক্তি নাকি স্বয়ংসম্পূর্ণ, তো ইউরেনিয়াম কি সূর্যের অংশ নয়! সেই তো সূর্য থেকেই বিচ্ছিন্ন পৃথিবীর খনিজ, আসলো কোথা থেকে? তো যাই হোক, গাছ এ ব্যাপারে ফার্স্ট পার্সন। তাই একটুও না নড়ে বা নড়ার প্রয়োজন ছাড়াই সব কাজ করিয়ে নেয় সকলকে দিয়ে। প্রজননের কাজই করায়। খাদ্য তৈরী করে বাড়তি শরীরে আনে ফুল, তাতে দেয় রঙ বা মধু। সেই রঙে-মধুতে-ম্যাজিকে আসে কত মৌমাছি, প্রজাপতি ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের পায়ে পায়ে রেণু লেগে মাখামাখি হয়ে আসে নিষেক। নিষেকে আসে ফল, ফলে আসে বীজ, আর বীজে আসে প্রজন্ম। বেটাচ্ছেলে নড়বেও না, সব করিয়ে নেবে, আবার না নড়েই দূরে ছড়িয়েও দেবে নিজের বংশ। কোন পাখি, কোন ফলে স্বাদ পাবে আর সে স্বাদের চক্করে ফল খেয়ে উড়ে উড়ে কোন পাড়ায়, কোন গ্রামে, কোন মহকুমায়, কোন দেশে যে বীজ ফেলবে লাগাতার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যে তার ইয়ত্তা নেই।

এভাবে ভেবে দেখবেন, মানুষও তাই, সেই প্রজননের চক্করেই-তো রামায়ন, মহাভারত, ইলিয়াড, ওডিসি বা তার ইতিহাস-ভূগোল-বিজ্ঞান রচনা করেছে। এভাবে কীট পতঙ্গ সকলের আলাদা স্টাইল। আগেও সে কথা বলেছি।পাঠক একটু ভাববেন সকল ক্ষেত্রে, এক অনাবিল সত্য ও আনন্দ পাবেন। সকলে সকলের জার্নির দ্বারা এফেক্টেড বা জড়িত। মানুষের কথাই ধরুন না,একজন সন্তানসম্ভবা মা'কে যা যা খাবার দেওয়া হয় (প্রাণী ও উদ্ভিদের বলিদানে), বা সন্তান ধারণের উপযুক্ত।

শরীর নির্মানে যা যা লাগে, তার সাথে সমগ্র জগতের খাদ্য খাদক সম্পর্কের কি নিদারুণ ও দূর্দান্ত দেওয়া নেওয়া বলুন তো!! এমন করে মানুষের শরীরও তো কারো কাজে লাগতেই পারে, এবং লাগেও, তাই না?? সে কৃমিও হতে পারে আবার ভাইরাসও।

হ্যাঁ, করোনাও তো ভাইরাস। এমন হাজার ভাইরাস আছে তার প্রজননের জন্য যুগে যুগে বাকীদের মতই নানা ধরণের প্রাণীর শরীরকেই বেছে নেয়। শুধু ভাইরাস কেন, অনেক মাছি আছে যারা বিভিন্ন প্রাণীর শরীরের নানান স্থানে ডিম পাড়ে, চোখে, মুখে, মলে নানা ভাবে। সে প্রানীর শরীরের নানান অংশে নানান প্রক্রিয়ায় ঘুরে ঘুরে সে মাছির লার্ভার জীবনচক্র ঘটে। এমন আছে হাজার হাজার প্রাণী স্থলে জলে ডাঙায়। তো এই ভাইরাসও তাই-ই করে, ও তাও প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে সৌরবিজ্ঞানের মূল সূত্র ধরে একথা তো মানতেই হবে। সে ক্ষেত্রে কেউ  না কেউ তো কোলাটেরল ড্যামেজ হবেই। দেখেছেন না, কত মুরগী  বা পাখি বা প্রাণী কোন এক বছরে খুব মরে! সেবার ওই ভাইরাস সেই প্রাণীকে প্রেফার করে। এবারে কোভিড-১৯ মানুষকে টার্গেট করেছে। সে তার প্রজন্মের কাজ করছে নিখুঁত ভাবে, আমরা খেসারত দিচ্ছি, যেমন প্রতিবারেই আমাদের জন্যও কেউ না কেউ দেয়ই। আর এ জিনিস সে ভাইরাসের নির্দিষ্ট প্রজনন সময়ের আবর্তন পেরিয়েই তো আসবে, এ-ও খুব স্বাভাবিক। প্রতি প্রাণীরই আলাদা আলাদা প্রজনন পিরিয়ড থাকে, ওই যে কারো ন-মাসে বছর তো কারো ছ-মাসে, আবার কারো বারো মাসে, কারোর কারোর বহু বছরের ফারাকে। এমতাবস্থায় আমাদের কাজও আমরা করব, সেটাও স্বাভাবিক। কিন্ত সৃষ্টির এ ধারায় এমন মুহুর্ত আসবেই বারবার একথা বলাই যায়। কোনও বিচক্ষণ মানুষ অন্ততঃ এ নিয়ে ফ্রাস্টেটেড হবেনা হলফ করে বলতে পারি। তবে সতর্ক হতেই হবে। বাঘও হরিণের পালে ঝাঁপায়, সতর্ক হরিণকেও হতে হয়। সকলকেই। কিন্তু প্রজনন চলবে। জীবনের প্রয়োজনে ও বিনিময়ে উদ্ভিদ প্রাণী ভাইরাস সকলের খেলা চলবে, তাই কোরোনা নিয়ে ব্যক্তিগত আমার কোনো বিকার তৈরী হয়নি আলাদা করে এই অসময়ে।

তার মানে এই নয় যে, এতখানি গৌরচন্দ্রিকা আমি এই একটুখানিক সিদ্ধান্ত দেবার জন্য লিখলাম। এই করোনা পর্যায়ে যা গেলো তা তো সকলেই জেনে গেছেন মিডিয়ার ও জীবনের ভোগান্তিতে। কিন্ত আমার মনে যেহেতু এই করোনা নিয়ে কোনো বিকার তৈরী হয়নি সেভাবে, তাই কি কি অন্যভাবে পেলাম এই কয়েক মাসের কোরান্টাইনে, তা বরং অনেক বেশী মনোগ্রাহী হয়েছে আপন অভিজ্ঞতায়। জন্ম থেকে শিখিয়ে দেওয়া দৌড়াবার যে পাঠ পরিবার থেকে রাষ্ট্র ধরিয়ে দিয়েছিল প্রাণীজগতের আপন ইচ্ছার বিপরীতে, তা যেন জীবনে প্রথমবার নিষিদ্ধ হয়ে একটু ব্যক্তিজীবনের অবকাশে বা থামায় ফিরিয়ে দিল। চোখ মেলে চেয়ে দেখলাম আপনজনদের, দেখলাম তাদের আর আমার প্রাণের দেওয়া নেওয়াকে, যেহেতু রাজার অসুখের পাঠ আমার পড়া, তাই খাবার দাবার শোয়ার পরার চিন্তাও ছিলো না পরম চিন্তামণির আশীর্বাদ পুষ্ট ওই গাছতলার পাগোলের মতই। সামান্যতেই দিব্যি চলে যায় আমার। কিন্ত জানি সকলের এ সামান্য সুযোগটাও ছিল না। হাজার হাজার শ্রমিকের ঘরে ফেরার করুন গল্প, দুনিয়া জুড়ে চিকিৎসা আর মৃত্যুর টানাটানি, রাষ্ট্রনায়কদের একে অপরের ওপর দোষারোপ, বন্ধ বাজার, কালোবাজার সবের মধ্যে স্বার্থপরের মত ভাল থাকার গল্প বেশী করে শোনাতে চাই না তাই। আসলে জীবনের প্রয়োজনগুলো একেবারে সামান্য করে নিলে আর চাহিদার হাতছানিকে টাটা করে দিলে যে অনাবিল আনন্দ পাওয়া যায় শৈশবের সামান্য জিনিসের মতো, সেই আনন্দেই আমার বেড়ে ওঠা। তাই সত্যিই সমস্যা হয়নি। সামান্যতেই বাঁচার অভ্যাস আজকাল তো কেউ একটা করেওনা, যদিও এসময় দায়ে পড়েই করেছে কেউ কেউ।আর আমি করেছি মুক্তি ও একটু হাঁপিয়ে নেবার অবসর যাপনের ফুরসতে।জন্ম থেকে শুরু যেহেতু একেবারে শূণ্য হাতে, ভাগ্যচক্রে সেখান থেকেই, তাই মাটি-গাছপালা-ফুল-ফল-মাছ-পুকুর-চাষবাস ইত্যাদির সাথে ফিরে গিয়ে করোনার কোনো যন্ত্রণার জীবন যাপন আমি সজ্ঞানে আমাতে আর আমার পরিবারে ঢুকতে দিইনি।হ্যাঁ, আমাদের বাড়িতে বোকাবাক্সটাও চলেনা বহুদিন। তাই প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যে ভয় দেখানোর কেউ ছিল না বলাই বাহুল্য। তাই বলে কি এই করোনা ও কোয়ারেন্টাইনের খারাপ প্রভাব আমার জীবনে পড়েনি বা পড়বেনা? আলবাৎ পড়বে, আর আমি সেটা জানি, ওই যে বললাম, সবাই সৌরবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত।

প্রথমত বিশ্ব অর্থনীতিতে বিরাট ধাক্কা মেরেছে করোনা। পুরো মানব জাতির দেওয়া নেওয়ার মূল সূত্রগুলি একেবারে ঘেঁটে ঘ হয়ে গেছে। এমনকি মানবিক সম্পর্কগুলিও হয়েছে অচ্ছ্যুৎ। ফলে পেটে টান, শরীরে প্রভাব ও মনে বিষাদ সব একসাথে মিশে অর্থনীতি, সমাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি একসাথে জোর ধাক্কা খেয়েছে আর কার্যকারণ সূত্রে টপ টু বটম নানা ভাবে এই আওতায় পড়ে নানাভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে। এইবারে সে সকল ক্ষয়ক্ষতির প্রভাবের পালাও চলবে আগামী এক দশক অন্ততপক্ষে বিশ্ববাজারে ও ভূমন্ডলে। তাই বিচলিত না হয়ে ঠান্ডা মাথায় ও সতর্ক মনে সেসকল পর্যায়গুলির জট সকল মানুষকে ভেবে ভেবে ছাড়াতে হবে। কারণ মহামারী কোনো শ্রেণী বা দেশ দেখেনি, দেখেনি বুর্জোয়া বা প্রলেতারিয়াত। পুরো ঢেলে সাজিয়েছে সকলকে, বিশ্বনাগরিককে, সকলকে একই সূত্রে বেঁধে দিয়েছে, যেটা বুদ্ধিমান মানব জাতি অদ্যাবধি পারেনি। একই ভাবে ভাবাতে পারেনি বলেই আজ এত অসাম্য, এত যুদ্ধ বিগ্রহ, এত অভাব অভিযোগ। আর এখন সব ঠান্ডা। সব একই সূত্রে কোয়ারেন্টাইন।

আর এভাবেই সকল দিকের মতো বিনোদনের বাজারেও থাবা মেরেছে করোনা। এইবার আমার বিষয়ে ঢুকছি।বিনোদন কি বলুন তো! সারাদিন পর পরিবার তথা রাষ্ট্রগঠনে নিযুক্ত মানুষের ঝাঁক একটু মানসিক শান্তি ও রিফ্রেসমেন্টের জন্য নানান বিনোদনের দুনিয়ায় দারস্থ হয়। খানিক আনন্দ-হাসি-কান্না-হা হুতাশ ক্যাথারসিস হয় তার ভেতরে। প্রাচীন যুগ থেকেই শিল্প সংস্কৃতি মানুষকে সংস্কার করে এসেছে, বিনোদনের ছলে পথ দেখানোর প্রতিশ্রুতি ও সময়কে মার্কড করতে করতে এগিয়েছে। সে আপনি গুহাচিত্র দেখুন আদিম কালের বা ক্যামেরুণের 'টাইটানিক' বা শম্ভুবাবুর 'অয়দিপাস' বা রবিঠাকুরের 'রক্তকরবী', ব্যাপারটা তাই-ই। জাতির জীবনযাত্রা জেনে যাবেন শিল্পে। সময় ও মানুষের মিলিত এই শিল্পকর্ম নামক জিনিসটি কর্মমুখর মানুষের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি অঙ্গ। কিন্তু কালে কালে সেসবের ভাব গতিক পাল্টালো। বিনোদনের ফুরসত হয়ে দাঁড়ালো কল্পলোকের কারখানা। ডিজিটাল যুগের আগমনের সাথে সাথে তা আরো গ্রাস করে ফেলল প্রজন্মকে। বাড়াবাড়ি বিনোদনের হাজার মাধ্যম আর তাকে ঘিরে কর্পোরেট এর বিরাট ব্যবসা প্রজন্মকে অলস কুঁড়ে আর ভার্চুয়াল বানিয়ে তুললো। প্রেম-পিড়ীতি-যুদ্ধ-নাচা-গানা-উত্তেজনা সব মিটতে থাকলো এই পর্বে। সত্যি-কর্ম হয়ে গেল কল্পলোকের দাস। প্রত্যকের কর্মগুলি সেরে ফেলতে লাগলো তাদের মনজগতে তৈরী হওয়া নায়ক বা নায়িকাদের দ্বারা। সকলেই ভাবে ওটা আমি, এটা আমি, কিন্তু কেউ তা হয়ে ওঠে না, হয়ে ওঠায় যাকে দিয়ে সে ওই কল্পলোকের সাজা মনোরঞ্জন কর্মী। সেও সঙ, এ-ও সঙ। যে দেখায় ও যে দেখতে চায়, দুয়েই। দুই সঙেতে মিলে কর্ম ও শিল্পের মূল ছন্দগুলিকে বা জীবন ও বিনোদনের মূল সূত্রগুলিকে বিনষ্ট করতে লাগলো। আর তা করলো কর্পোরেটের মুনাফার ছকে, বলির পাঁঠা হয়ে। উভয়েই কিছু পেলো, আর হারালো প্রায় সর্বস্ব, কালে কালে তা-ই হল বিনোদন বাজারে। আর এইসময়ে এল করোনা তার বায়োলজিকাল প্রজনন বিস্তারের যাত্রাপথে। ধরলো এই হাওয়ায় ভাসতে থাকা মানব প্রজন্মকে, যাদের দূর্বল, না-খাটা, অতি-আয়েশী ফুসফুসে আপন ছানা পোনা ছাড়তে ও বসবাস করতে। ব্যস লেগে গেলো অসুখ, মহামারী।

আসলে অসুখটা ছিলই। জাতের অসুখ। পাতের অসুখ। সারা দুনিয়া জুড়েই চলছিলো নানান রন্ধ্রপথ ধরে মানব মনের। এ ওকে কামড়াচ্ছিলো, সে তাকে শেষ করছিল বাড়িতে, পাড়ায়, গলিতে, দেশে, মহাদেশে। সবই বিনোদনের অন্তর্ভুক্ত। আলাদা করে থিয়েটার, সিনেমা বা যাত্রাপালা বা লোকশিল্পের নানান ফর্ম ছাড়াও লাইফস্টাইল দেখা ও দেখানোর নেশাতেই পরতে পরতে বিনোদন ছড়িয়ে আছে, যা প্রয়োজনের অতিরিক্ত, তাই তো বিনোদন। খিদের বাইরেও খাবার খেতে বা দেখে বিনোদন হয়। আবার ভালো পোশাকেও বা অতিভালো থাকাতেও বিনোদন। আর যখন তা একে অপরকে মেরে কেটে বঞ্চিত করে অর্জন করতে হয় তখন তা ডেফিনেটলি অতিরিক্তের থেকেও অতিরিক্ত। তাই মানুষ তো মানুষ, সরাসরি বিনোদন কর্মীদের মাথায় হাত পড়লো। কারণ মুমূর্ষু মানুষ হঠাৎ নড়ে চড়ে বসে পড়লো বাস্তবের তাগিদে, বাঁচার তাগিদে। সকলেই ঘরে বন্দী হয়ে যাবতীয় ফ্যান্টাসিগুলিকে অনুভব করলো আর বাস্তবের মাটিতে ঘষা খেয়ে  ফিরলো খানিকটা জীবনে ও জীবন বাঁচাতে। কারণ সে জানে এখানে কোনো রিটেক নেই, রবার নেই, কাঁচি নেই, রঙ নেই, ম্যানেজ নেই। সিধা মরবে, সিধা ওপরে। অব, তেরা ক্যায়া হোগা কালিয়া??

কালিয়া মানে বিনোদনের বাজারে তাই ধস। ওদিকে বড় বড় সিনেমা প্রোডিউসাররা অর্থনীতির ধাক্কায় আর ছোট ছোট থিয়েটার কর্মীরা মানুষের ছোঁয়ার ধাক্কার ভয়ে গুটিয়ে নিলো আপন আপন খাপ। এমন ভাবে নাচে গানে ভার্চুয়ালে-ডিজিটালে-ম্যানুয়ালে সর্বত্র চাপ এলো। চাপ এলো শিল্প-কর্মীদের সকলের।

আসলে এবারে যেটা হল, আসলের ধাক্কায় নকলের কারিগরদের তুলনামূলক হেলা করলো মানুষ। সত্যিকারের চাল-ডাল ওষুধের দাবীতেই অনড় থাকলো। ভুলেও বিনোদনের বায়না ধরলো না। কারন মরনশীল মানুষ সর্বদাই জীবনমুখী। আর ঝাড় খেলো শিল্পীরা, শিল্প-কর্মীরাও। আমদানি না এলে ঘর পরিবার চলে কি করে! থিয়েটারের আলো করা ছেলেটার ঘরে আলো নেই, সিনেমার ট্রলি ঠেলার মানুষটার জীবন এগোচ্ছেনা, সাউন্ডের ছেলেটার বাড়িতে বাচ্চার কান্নার শব্দ, রঙের মানুষটা নিজেই ফ্যাকাসে আর পারফর্মারদেরও ফর্ম বা ফর্মা শেষ একই তালে। আর তারই ফাঁকে জুকারবার্গ আর আম্বানীর ডিজিটাল খেলাঘর কম্বিনেশনে গাদা গাদা ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা বিনোদন ফ্রি স্যাম্পেল ছড়াতে থাকলো। এপার ওপার কেউ কিচ্ছু পেল না, পেল কেবল মহাজন। মহাজনেরা দুর্ভিক্ষের বাজারে মহান জনের মতো বাজী মেরে রাখে। কারণ বেচা এমন এক মজার জিনিস যে বুদ্ধি খাটালে সব বেচা যায়, বেচেও মানুষ। শিল্পী সে ব্যাপারে চিরকাল দূর্বল, বিশেষ করে খাঁটি শিল্প ও শিল্পী দুটোই বেচার বাজারে এক্কেবারে অচল। বরং উল্টোপথেই বেশী যাতায়াত।

তাই আমি আপাতত ঘোর অনিশ্চয়তাই দেখতে পাচ্ছি এ দুনিয়ায়। কোনও কিছুকেই আলাদা করে বিচার করার জায়গায় নেই, কেউই নেই। মানুষগুলোকে ঘিরে থাকা বিনোদন বা বিনোদনকে ঘিরে থাকা মানুষগুলো আজ করোনাহত। ভাইরাসের প্রজননের কোলাটেরল ড্যামেজ। করোনার বহু আগে থেকেই চাষী মরছে অনাহারে, অভিমানে। নাগরিক মরছে ক্যান্সারে, যুদ্ধে, বিগ্রহে, অনাচারে, অত্যাচারে, করোনার বহু আগে থেকেই। সেসবের বিচার  জমা হয়ে পড়ে আছে। এতদিন বিনোদনে মত্ত থাকা মানুষের বেহুঁসপণায় সেসব চাপা ছিল। আজ টনক নড়েছে। তাই এই লাইনে আপাতত একটু টান যাবেই দাদা। রক্তকরবীর শেষে ওই পৌষের ধান কাটার গান গেয়েই শিল্পী, শিল্প গা-ঝাড়া দিয়েছে, মানুষ নাচ গান অভিনয়ের আনন্দ নিয়েই কেটে পড়েছে। কেউ জানেইনা, পৌষের গান কেন আর গায় না মাঠের মানুষেরা,তারা কেন গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে ঝুলে মরে যাচ্ছে!!! কেউ খবর রাখেনা। তাই রক্তকরবীর কারিগরেরা একটু পিছিয়ে পড়েছে প্র‍্যাক্টিক্যালি। এবারে জ্যান্ত সময় এলো বোধহয় করোনার হাত ধরে, চেয়ে চিন্তে ধান ফলানোর সময় এলো বোধ হয় সত্যিকারের। নন্দিনীদের এবারে মাঠে ফিরে সদলবলে চাষের কারিগরদের মৃত্যুর পালা থামানোর আর দিনবদলের লাল বিপ্লবের নতুন রক্তকরবীর সময় এলো বোধ হয়!! কারণ সেখানেও যে বসে আছে কর্পোরেটের কালো থাবা, বীজ দখলের কোম্পানীশাসন ও বীজের নির্বীজকরণ, ল্যাবরেটরির ইনভেস্টমেন্ট আর জমি দখলের খেলা। সে গল্প আর একদিন, একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন পাঠক। আর খেলার আসল বাজিটা ওখানেই।

আমি আপাতত তাই মাঠেই আছি। বিনোদনের হাত ধরেই ফিরব এই আশায় বাঁচি না বরাবরের মতো। তবে বিনোদনে জীবনের গল্প বলবো ফিরে এসে। এ জিনিস ফিরবেই, পচা গলা সস্তা হলেও বিনোদন ফিরবে।কর্পোরেটেরাই ফেরাবে। একটু নিজেরা সামলে-সুমলে নিক। ততদিন আমি মাঠেই থাকছি। আর তার ফাঁক ফোকরে টুকটাক আদিম গুহাচিত্র যাপনের মত ব্যক্তিচর্চা, ব্যাস। বাকী দুনিয়া??? কে জানে??  অন্তত এই সময়ে দাঁড়িয়ে কেউ জানেনা!!! মাঠেই শিল্পের মুক্তি। কৃষ ধাতুর কৃষি ও কৃষ্টির দুই রুপ তো আসলে এক ও অভিন্ন।তাই মাঠেই চর্চা প্রাণী আর উদ্ভিদ জগতের প্র‍্যাকটিকাল কর্মে। আর সেখানেও মূল খেলা ও বিদ্যা, সেই সূর্য, সৌরবিজ্ঞান। যাবে কোথায়! প্রজন্ম মানেই তো আগামী। আগামী মানেই তো ভবিষ্যৎ। আগামীর ভবিষ্যৎ মাঠে। সরাসরি সূর্যের আসল ক্রিয়েশনে। আর লড়াইটা এখান থেকেই শুরু। হ্যাঁ, করোনার বিরুদ্ধেও। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেও।


Post a Comment from facebook

1 Comments

  1. বা! সুন্দর লেখা। একটা প্রতিবেদনের মতো হয়ে উঠেছে সাহিত্যের রং-রস নিয়ে। সৌরজগত-প্রাণ-প্রাণী-জীব-জীবন আর তার প্রবহমান ধারার মধ্যে কেউ অপ্রয়োজনীয় হতে পারে না, এমনকি এই নভেলা-করোনাও,শিল্পীর এই ভাবনাকে যুক্তিযুক্তভাবে এখানে আনা হয়েছে অসম্ভব দক্ষতায়। মা্নুষকেও আলাদা করে ভাবার কারণ থাকতে পারে না, এই জীবনচক্রে, যেখানে প্রজনন প্রত্যেকের প্রাথমিকতা। আবার নিজস্ব ক্ষেত্রটি নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আমি সহমত। সেখানে শিল্প-বিনোদন-সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীত-বিভিন্ন শ্রেনীর ভূমিকা- রাষ্ট্রের ভূমিকা- আর তারই প্রেক্ষিতে ব্যক্তি-শিল্পীর ভূমিকার কথা উঠে এসেছে যুক্তির সঙ্গে নান্দনিকতা মিশিয়ে। ব্র্যাভো। খুব ভালো লেখা। ভালো থাকুন।

    ReplyDelete

Post a Comment

Previous Post Next Post