‘ভেল’-এ (BHEL) কর্মরত। হরিদ্বারবাসী। কবি ও সম্পাদক। চাকরির কর্মব্যস্ততা সত্ত্বেও কবিতা লেখা ও প্রকাশে উৎসাহী। করে চলেছেন পত্রিকাও।

করোনাক্রান্তি 

শিবু মণ্ডল


ভাইরাসের খোঁজে 

একটি ভাইরাস যে কিনা এককোষী জীব ও জড়ের মধ্যবর্তী একটি বিষয়। আর এই বিষয়টি বর্তমানে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাইরাস তো মানুষের আগে থেকেই এই পৃথিবীতে এসেছে বা ভালো করে বললে পৃথিবীতে প্রাণীর সৃষ্টির মূলেই এই ভাইরাস। সে জীব ও জড়ের মধ্যে এক সীমান্তরেখা। এ রেখা যেন এক রহস্যময় আলোছায়ার খেলার মতন। হতে পারে ব্রাহ্মমুহূর্তের মতো অলৌকিক। হতে পারে গোধূলির মতো মায়াবী। অথবা জন্ম ও মৃত্যুর মতো অমোঘ। এই সীমারেখাটিকে কে কবে অতিক্রম করতে পেরেছে? ইতিহাস ঘেঁটে আমরা হয়তো প্রমাণ করতে পারবো যে মানুষ তা পেরেছে, কিন্তু সেটাই প্রকৃত সত্য নয়। সময়ের সাথে সাথে ভাইরাস নিজের প্রকৃতি পাল্টে পাল্টে মানুষকে আক্রমণ করে তার অসহায়তা প্রমাণ করে দেখিয়েছে। আর তার একটা মূল কারণ এটাও হতে পারে যে আমরা আমাদের আসল প্রকৃতি সময়ের সাথে পাল্টে পাল্টে নিয়ে প্রমাণ করতে সচেষ্ট হই যে আমরাই শেষ কথা বলব। কখনো কখনো হয়তো অনুভব করি যে এ সবকিছুই হচ্ছে কোনও মহাপ্রকৃতির ইশারায়। আর আমরা প্রায়ই ভুলে থাকি যে রহস্যময় ইশারায় এই বিশ্ব-প্রকৃতি চলছে সেই ইশারাতেই আমরা। আমরা আমাদের প্রয়োজনে প্রকৃতিকে নির্বাচন করিনি। প্রকৃতিই আমাদের নির্বাচন করেছে মহাবিশ্বলোকের প্রয়োজনে। যে অনন্ত সময় ও ধৈর্য নিয়ে সেই মহাপ্রকৃতি এই সৃষ্টি রচনা করেছেন তার কতটুকু আমরা অনুভব করতে পারি! এই যে এখনও এই আশঙ্কা ও এক অনিশ্চিত আগামির এলোমেলো সময়তেও ঘুম থেকে উঠে দেখি সূর্য উঠছে পূবের আমবাগানটির ভেতর থেকে। হরিদ্বারে বসে তখন মনে পড়ে এই সূর্যটিই তো শিলিগুড়িতে আমাদের বাড়ির মুখোমুখি প্রাচীন বটগাছটির মাথা ছুঁয়ে রোজ সকালে ওঠে। পাখিরা আনন্দে, প্রভাতি সঙ্গীতে স্বাগত জানাতে তখন প্রথম কিরণের সাথে উড়ে যাচ্ছে আর ক্রমশ প্রলম্বিত হচ্ছে তাদের ছায়া সংসার জুড়ে এক দিবালোকের দিকে। আর অন্যদিকে মানুষ প্রকৃতি ও তার সাজানো ভাণ্ডারকে স্বার্থপর, একচ্ছত্র অধিপতির মতো লুণ্ঠন করার পরেও কিন্তু প্রকৃতি উদাস থেকেছে। আর আজ যদি মনে করা হয় যে বর্তমানের করোনা মহামারী এই মহাপ্রকৃতিরই মানুষের প্রতি তার বদলা নেবার এক উপায় মাত্র সেটাও মানব মনের জটিল এক অঙ্কের হিসাব। এ হিসাব ভয়ের সাথে এক সমঝোতায় আসা। কোনও ভাবেই অনুতাপ নয় তা। অথচ এই পৃথিবীর হাওয়া-বাতাস-জল-পাখপাখালি আরও যেন নির্মল ভাবে মানুষের এই অসুখের ক্ষতে প্রলেপ দিতে বেশি করে তৎপর। কিন্তু হায় আমরা আমাদেরই পাতা ভুবনজোড়া এক জালে ফেঁসে গেছি। এর থেকে মুক্তি আমাদের আর নেই। করোনা থেকেও সম্ভবত খুব সহজে মুক্তি পাওয়া যাবে না।  

তবে করোনা ভাইরাস তো একদিন চলেও যাবে, কিন্তু এই ভাইরাসের ভয়ে লকডাউনের এই নির্বাসন কি আমাদের চোখ খুলে দিয়ে যাবে না? আমাদের প্রকৃত স্বরূপকে জানতে এবার অন্তর্মুখী হতে শিখবো না আমরা ? করোনার থেকেও তো ভয়ঙ্কর সব ভাইরাস এই সভ্যতায় শেকড় গেড়েছে, ধীরে ধীরে যা ছড়িয়ে গেছে প্রতিটি মানবমনে, তাদের চিহ্নিত করে তার থেকে মুক্তির চেষ্টা করবো না? প্রতি মুহূর্তেই মানবিকতার চূড়ান্ত ধর্ষণ হতে দেখি পৃথিবীর কোণে কোণে। লোভ, ঘৃণা আর হিংসা এমনভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাচ্ছে যেন এগুলো আমাদের মৌলিক অধিকার হয়ে গেছে। মানুষ নিজেকে ছাপিয়ে যেতে চেয়েছে। সে বানিয়েছে এমন সব মারণাস্ত্র যার প্রয়োগে কয়েক সেকেন্ডেই দু’লক্ষ বছর পুরনো এই মানব সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। আর মহামারীর এই সংকটকালে দাঁড়িয়ে আমরা আমাদের এই ভাইরাসগুলিকেও চিনতে পারবো তো? 

ছবিঋণ- পিটিআই

এই করোনা সংকটেই কেন, ব্যক্তিগত ঝড়ঝাপটার জীবনেও তো একই রকম অনুভূতি হয়। মানুষ তো কেবল শরীর ও মন এই হার্ডওয়্যার-সফটওয়্যার এর সম্মিলিত কোনও যন্ত্র নয়। আবার ভালোবাসাহীন হৃদয় তো এক যন্ত্রই। কীসের এমন তাড়া ছিল এই হৃদয়ের। আত্মিক টান থেকে দূরে সরে সবাই পায়ের তলায় এক যান্ত্রিক ব্লেড লাগিয়ে নিয়েছি। জয় শুধু জয় চেয়েছি। কে কত দ্রুত নিজের শেকড় কেটে কেটে জয়ধ্বজা ধরে এগিয়ে যেতে পারি। একটা উপনিবেশিক ধারণা নিয়ে গড়ে তুলি আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। আচ্ছা এই সংকটেই কেন আমার এমন বোধ জাগছে? লকডাউনের প্রথম দিকে কবি সমর রায়চৌধুরীকে ফোন করেছিলাম খোঁজ নিতে। বলল ‘ শিবু ভালো লাগছে না কিছু। রাস্তা একেবারে শুনশান। একটা কুকুর পর্যন্ত দেখা যায় না।’ যে রাস্তা ভালোবাসার হওয়ার কথা ছিল সে রাস্তা হয়ে গেছে আইনের আর শাসনের।সে রাস্তা রক্তাক্ত হয়েছে প্রতিদিন ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত শ্রমিকের রক্তে! সেই রাস্তাতেই আজ অনিশ্চয়তায় পড়ে যাওয়া কিছু মানুষ যখন হেঁটে ফিরছে বাড়ির দিকে তখন তাদের দশা সেই কুকুরের থেকেও অভিশপ্ত হয়ে উঠতে দেখলাম। দেখলাম ক্ষুধা নামক এক দৈত্যের থেকে মুক্তি পেতে হাজার হাজার মাইল পর্যন্ত পায়ে হেঁটে পাড়ি দিচ্ছে। পথের দুর্ঘটনা, ক্লান্তি আর না খেতে পেয়ে শত শত মানুষ মাঝপথেই প্রাণ হারাল। কেন? যে মানুষগুলি পুঁটলিতে ভালোবাসা বেঁধে ঘর ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলো জীবিকার কারণে ভিনপ্রদেশে সেই মানুষগুলিকে আমাদের আধুনিক সভ্যতা কেন নিশ্চয়তা দিতে পারল না এই সংকটকালে। যে মানুষগুলির পিঠে চড়ে সভ্যতার রথের চাকা গড়িয়ে চলে আজ হঠাৎ করে সারথির নির্দেশে রথ থেমে গেলে কেন তাদের সেই রথের চাকায় পিষ্ট হতে হবে? আজ এই রথে যে রথী- মহারথীরা বসে আছেন তাদের হৃদয়ে যদি এতটুকু মানবিকতা, ভালোবাসা বা অনুকম্পা থাকতো সেই মাটির মানুষদের জন্য তবে এমন একটি অভূতপূর্ব কঠিন সিদ্ধান্ত নেবার আগে তাদের কথা নিশ্চয়ই ভাবা হতো। আর সেটা হলে তাদের আগে থেকেই সসম্মানে ভালোবাসার পুঁটলি সহ যার যার ঘরে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করা হতো। কিন্তু তা করেনি। তাদের জীবনের সুরক্ষা না দিতে পেরে কাব্যিক একটা নাম দিয়েছে- পরিযায়ী শ্রমিক! আসলে কোনকিছুকে নামকরণে বেঁধে দিতে পারলেই সরকার দায়মুক্ত হয়ে যেতে পারে। আর দেশের মধ্যবিত্ত ও এলিট সমাজের লোকেরা সহজেই ওদের শ্রেণিভুক্ত করে ফেলতে পারে, ওদের ভবিতব্য নিয়ে আর কোনও দ্বিমত থাকে না ভদ্র সমাজের মধ্যে। কিন্তু এই মহামারীর সঙ্কট থেকে বাঁচতে সেই সভ্য ও সুশীল সমাজ যখন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে, প্রদীপের আলো জ্বালাচ্ছে তখন তারা হাততালির বিরতির মাঝে এক নীরব কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল না কি! প্রদীপের নিচেই যে কত অন্ধকার সেটাও নিশ্চয়ই দেখতে পেল। রাজনীতি ও ভোটের কারবারিরা বুঝতে না চাইলেও তারা নিশ্চয়ই অনুভব করল যে তাদের জীবন যতটা মূল্যবান ঠিক ততটাই মূল্যবান সেই গরিব ও অন্ত্যজ মানুষগুলির। পার্থক্য শুধু চারদেওয়ালের ভিতরে থাকা মানুষটি বাঁচতে চাইছে করোনা ভাইরাস থেকে আর পথে বেরনো মানুষটি বাঁচতে চাইছে অনাহার থেকে। প্রকৃতি কি এভাবেই আমাদের মাঝে মাঝে একই সারিতে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় নিজেদের জানতে, চিনতে!         

 

কোভিড-১৯ মহামারী- একটি পরিসংখ্যান মাত্র  

বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা ‘হু’ মার্চের ১১ তারিখে যখন কোভিড-১৯ কে মহামারী ঘোষণা করে তখন ১১৪ টি দেশে করোনার ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। মোট পজিটিভ কেস প্রায় ১২৪০০০, মৃত ৪৫০০ এর উপর। ভারতবর্ষে তখন মোট আক্রান্ত ৬০ জন। মৃত্যু শূন্য। ভারতবর্ষের সরকার পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন সঠিক সময়তেই। আর সেটা বুঝতে পেরেই বিদেশীদের আগমনের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেন। যেসব ভারতীয় করোনাক্রান্ত দেশ থেকে ফিরছেন তাদের জন্য হোম কোয়ারান্টাইনের নির্দেশিকা জারি করেছেন দ্রুত। এরপর ২৩শে মার্চ মাত্র কয়েক ঘণ্টার নোটিসে পুরো দেশে সম্পূর্ণ লকডাউন ঘোষণা করা হয়। 

ছবিঋণ- www.caravanmagazine.in

কিন্তু আজ যখন সরকার ধাপে ধাপে লকডাউন তুলে দিচ্ছে আর আমরা মনে মনে একরকম সবাই প্রস্তুত যে আগামি দিনগুলি করোনাকে সাথে নিয়েই আমাদের চলতে হতে পারে তখন একটি প্রশ্ন মনে স্বাভাবিকভাবেই এসে যায় যে এই লকডাউনে দেশের সবার কতটা ভালো হল বা কতটা ক্ষতি হল? লাভের কথা বললে এই লকডাউনের ফলে সরকার তার মেডিক্যাল সিস্টেমকে প্রস্তুত করতে পেরেছে, জনগণকে সজাগ ও সচেতন করতে পেরেছে। আর সবচেয়ে বড় যেটা উপকার হয়েছে এই লকডাউনে করোনার ছড়িয়ে পড়ার গতি অনেকটাই কমিয়ে দেওয়া গেছে এবং সাথে মৃত্যুর সঙ্খ্যাও। আজ যেখানে ভারতে প্রায় দুলক্ষ ছাড়িয়ে গেছে সংক্রমণের সংখ্যা আর মৃত্যু প্রায় ছয় হাজার সেখানে লকডাউন না হলে সম্ভবত সংখ্যাদুটি যথাক্রমে হতে পারতো ১৪-২৯ লক্ষ ও ৩৭-৭৮ হাজার পর্যন্ত। এটা আমার অনুমান নয় নীতি আয়োগের সদস্য ডঃ বিনোদ পল, যিনি আবার কোভিড-১৯ বিষয়ে গঠিত জাতীয় টাস্ক-ফোর্সের চেয়ারপার্সনও বটে তার হিসেব। একটা কথা অবশ্য বলে রাখা ভালো এই বিনোদ পলই ২৪শে এপ্রিল গাণিতিক চার্ট ও মডেলের মাধ্যমে এক সাংবাদিক সম্মেলনে দেখিয়েছিলেন যে  ১৬-ই মে’র পরে দেশে নতুন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা শূন্যে নেমে যাবে। যাই হোক সেটা হয়নি। তবে আমার মনে হয় সেটা হতে পারতো যদি ১১ মার্চের ঘোষণায় হু’র নির্দেশিকা বা উপদেশগুলি সরকার আরও কঠোরভাবে পালন করতো। সেদিন ‘হু’ যে গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলি রেখেছিলেন বিশ্বের দেশগুলির কাছে সেগুলির কিছু হল ১. সম্ভাব্য মহামারী ঠেকাতে প্রস্তুত হন এবং তৈরি থাকুন ২. আইসোলেট, ১০০% টেস্ট, ট্রিটমেন্ট আর যারা সংস্রবে এসেছে তাদের চিহ্নিত করা। এবার যদি ধরে নিই যে বর্তমানে ভারতবর্ষে যত করোনা পজিটিভ তার প্রায় সবই( পুরনো কয়েকটি কেস বাদ দিলে) ছড়িয়েছে ১১ ই মার্চের পর থেকে লকডাউন ঘোষণা পর্যন্ত বা তার পরের কয়েকদিনে সরকারী উদ্যোগে বিদেশ থেকে নিয়ে আসা ভারতীয়দের মাধ্যমে। তবে সরকারের হাতে যথেষ্ট সময় ও আর্থিক সঙ্গতি নিশ্চয়ই ছিল সেই সব বিদেশ থেকে আগত নাগরিকদের সবাইকে সরকারী উদ্যোগে কঠোরভাবে কোয়ারান্টাইন করে সবার কোভিড টেস্ট সুনিশ্চিত করা। এবার অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন যে এটা যথেষ্ট খরচা সাপেক্ষ। কিন্তু কথা হল লকডাউনে যে ক্ষতি হয়েছে বা সরকার সরাসরিভাবে যে আর্থিক প্যাকেজ দিয়েছে তার তুলনায় পূর্বোক্ত খরচটা কি নগণ্যই হতো না? আর হয়তো এতে সরকারকে পুরো দেশজুড়ে লকডাউনে যাবার দরকারই পরত না। তখন আন্তর্জাতিক বিমান ও অন্যান্য যাত্রার মাধ্যমগুলি সম্পূর্ণরূপে ও দেশিয় যাত্রামাধ্যমগুলির কিছুদিনের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই হয়তো আমরা অনেক ভালো স্থিতিতে থাকতে পারতাম সে করোনা পরস্থিতিই হোক বা আর্থিক স্থিতি সব দিক থেকেই। 

 

একটি গিরগিটির চোখে করোনাসঙ্কট 

এখন আমার প্রচুর সময়। এসময়ে অনেককিছুর সাথে সাথে তথ্য গ্রহণেও এতটুকু কমতি নেই। টিভি খুললেই গণিতের রাজ্য আবেশ করে রাখে আজকাল। এই গণিতে, পরিসংখ্যানেই আমার বরাবরের ভয় ছোটবেলা থেকে। এই ভয়ের রাজ্যে ভীষণ একলা হয়ে পড়ি। একাকীত্ব কাটাতে কতরকমের ভাবনা, দুর্ভাবনা আঁকড়ে ধরি। মার্চের শেষের দিকে যখন সব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলি টার্গেট পূরণ করতে শেষওভারের মতো চালিয়ে খেলছে ঠিক এমন সময়েই ছন্দপতন। প্রায় পঞ্চান্ন বছরের পুরনো সংস্থা ভেল যা কোনোদিন কোনও শ্রমিক হরতালে বন্ধ হতে দেখিনি তাতে যখন তালা ঝুলল ভেবেছিলাম হপ্তাদুয়েক পর ঠিক খুলে যাবে। ঘরে বসে বসে করোনার ভয়ের সাথে সাথে আরেকটি ভয় মাথায় জাগছিল তা হল এই দীর্ঘ লকডাউনে দেশের আর্থিক অবস্থার দুর্দশা কোন পর্যায়ে যেতে পারে! গৌতম, গুলফাম, সুরেশ আমাদের কারখানায় ঠিকা শ্রমিকের কাজ করে। মাঝে মাঝে ফোন করে জানতে চায় কবে কারখানা খুলবে, কবে ওরা কাজ পাবে? আমি কোনও উত্তর দিতে পারিনা। 

মাঝে অবশ্য আমাদের কয়েকদিন ডিউটি করতে হয়েছে। এরমধ্যে আমাদের কোম্পানি একটি ডিসইনফেক্ট স্প্রেইং মেশিন ডিজাইন করে ফেলেছে। সেগুলো তৈরি করে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইতে আমরা সরকারের তথা জনগণের পাশে দাঁড়াতে পেরেছি ভেবে একটা ইতিবাচক সাড়া পাই এই দুর্দিনেও। প্রকৃতির এই মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মনোবল একটু বাড়ে। ব্যক্তিগতভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়টা আমার কাছে বিজ্ঞানের মতই একইসাথে বিস্ময়ের এবং ভয়ের দুটোই। যেখানে খুব সহজ ও লোভনীয় হাতছানি থাকে সেখানে আড়ালে এক ভয়ও সুপ্তভাবে থেকে যায়।একটা সুবিধাবাদী ও পুঁজিবাদী গোষ্ঠী যুগেযুগে আধিপত্য বিস্তার করেছে এই প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করেই। যদি এর সার্বিক কল্যাণকর দিকটির চাইতে  আমরা এর ব্যবসায়িক ও বাজারের দিকটি প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত মাত্রায় গুরুত্ব না দিতাম তবে একটা তুলনামূলক ভারসাম্য অবস্থায় থাকত আমাদের গ্রহটি। আজ এই করোনার সাথে এক প্রায় অসম লড়াইতে সর্বাগ্রে যে যোদ্ধারা তারা ডাক্তার ও নার্স। করোনা বা যেকোনো সংক্রামক রোগীদের চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে কীভাবে তাদের আরও বেশি সুরক্ষা দিতে পারা যায় তা একমাত্র প্রযুক্তির মাধ্যমেই ভাবা সম্ভব। ভবিষ্যতে তেমন কোনও প্রটেকশন গিয়ার তৈরি বা রোবট টেকনোলজির প্রয়োগ মহামারীর মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সাথে লড়াই করতে অগ্রগণ্য ভূমিকা নেবে এটা নিশ্চিত।তবুও মনে হয় এই প্রযুক্তি কি মানুষের সৃষ্টি আরেক ভাইরাস নয়? যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংক্রমণ করছে আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশকে। এরফলে একদিকে যেমন নানারকম কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে আরেকদিকে সামাজিক ও আর্থিক বৈষম্য আরও বাড়ছে। এই গ্রহের ভারসাম্য বিগড়েছে সবদিক থেকেই। মরণের সামনে জেগে ওঠা আত্মদর্শনের মতন দেখতে পাচ্ছি কী কী ভুল আমরা করেছি। হিমালয়ের ইকোলজিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আমরা পাহাড় জঙ্গল ধ্বংস করেছি। নদীর গলা টিপে ধরে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র বানিয়েছি। সুন্দরবন অঞ্চলের পরিবেশ ও সেখানকার জলবায়ুর কথা না ভেবেই তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র বসাতে উদ্যোগী হয়েছি। সেই বিদ্যুৎ দিয়ে শহর বন্দর আলোকিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের ও বাজারের একটি অংশ হয়ে ব্যক্তি আমিও কি এই পাপের অংশীদার হয়ে যাই নি? একদিন অফিসে একটি কাজ সেরে আমি ও আমার ঊর্ধ্বতন এক কর্মী হেঁটে হেঁটে ফিরছি (করোনাকালীন নতুন নিয়ম অনুযায়ী কোনোপ্রকার বাহন নিয়ে কারখানার ভিতর যাওয়া যাবে না বলে)। ধুলো-ধুঁয়া মুক্ত ফুরফুরে বাতাসে বিগলিত হয়ে বললাম- এই লকডাউনের ফলে ভালোই হল, না! বাতাসে কোনও দূষণ নেই, হর-কি-পৌড়ির গঙ্গার জল পানের উপযুক্ত হয়ে গেছে, প্রডাকশন টার্গেটের কোনও চাপও নেই। চারদিকে শান্ত পরিবেশ, মনও বেশ প্রশান্ত! সহকর্মীটি বলল সেটা তো ঠিক কিন্তু লকডাউন উঠে গেলেই তো আবার যে কে সেই! আবার পরিবেশ দূষণ, আবার টার্নওভার, টার্গেট, উপরওয়ালার চাপের পর চাপ। আর তাছাড়া কারখানা তো খুলতেই হবে। ব্যবসা না চললে আমাদের স্যালারিই বা আসবে কোথা থেকে?   

আমি চুপ করে যাই। টার্গেট, ব্যবসা, লাভ, বেতন, উপরওয়ালা... কে এই উপরওয়ালা? কারা এই উপরওয়ালা?      

আচ্ছা প্রকৃতি কি নিজেই একটা চেতনা? সে কি তার প্রতিক্রিয়াবশতই করোনার মতন ভাইরাস মাঝেমধ্যে প্রকট করে দেয় বিগড়ে যাওয়া ভারসাম্য ঠিক করে নিতে! হতে পারে। তবে কি এই করোনা ভাইরাস, এই লকডাউন সামগ্রিকভাবে পৃথিবীর ভালোই করবে? কি জানি! চিন্তাগুলো যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে। আবার একলা হয়ে পড়ছি ক্রমশ...               

ছবিটি লেখকের তোলা

ওদিকে একটি একলা গিরগিটি গেটের উপর বসে পাহারা দিচ্ছে আমার বাড়িঘর সব। যেন ট্রেঞ্চের বাইরে মুখ বের করে চারদিকে নজর রাখা এক সৈন্য। ওর একটা সীমান্তরেখা আছে। ওর বাড়ি কোথায় আমরা জানিনা। ওর সংসার বৌ-বাচ্চা আছে কিনা জানিনা। তবে একটা বুলবুলি এসে মাঝে মধ্যে ওর লেজে ঠোকর দিয়ে যায়। বুলবুলির টকটকে লাল তখন গিরগিটির মুখে এসে লাগে। রাগে নাকি লজ্জায় জানি না। বুলবুলিটির করোনাভীতি আছে কিনা গিরগিটি জানে না। তবে সে রোজ আসে খুনসুটি করে। ওই সামনের মাঠে একটা চিল রোজ এসে কিছু খড়কুটো তুলে নিয়ে যায়। রোজ সকালে বিকালে একবার করে আসে। গিরগিটিটি দেখে ভাবে ওই দূরের বটগাছটা থেকে চিলটা এসে ঠিক মাঠের ওই কোনটিতেই নামে কেন? ওর উড়ালের রেঞ্জ কি অতটুকুই। চিলটা কি বটগাছটায় নতুন করে বাসা বাঁধছে? আগে কোথায় থাকতো কে জানে! আমার আর কোথাও যাওয়া হল না এই ঝাড়ের বাড়ি ছেড়ে। এখন আবার চারিদিকে করোনা আর করোনা। আবার কবে যে কোনও দূরদেশে ঘুরতে যেতে পারবো কে জানে! আচ্ছা চিলটাকে কি সে জিজ্ঞেস করবে কোথা থেকে এসেছে? আচ্ছা ও কি করোনার ভয়ে কোথাও থেকে পালিয়ে এসেছে? ওর ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসন কি কিছু জানে না? ও কি সঙ্গরোধে থাকবে না? নাকি এরকম বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে! থাক বাবা বেশি আগ্রহ দেখিয়ে কাজ নেই।ওর নজরের আড়ালে থাকাই ভালো, কোনদিন না আমাকেই থাবা মেরে তুলে নিয়ে যায়! ওদিকে আমার চেনাজানা কিছু পরিযায়ী পাখি ফিরে এসেছে ওদের কথাই ভাবা ভালো।তবে ওদের পরিবার আগেই ওদের ওই দূরের মাঠে যে নতুন গাঁজা গাছের জঙ্গলটা গজিয়েছে ওখানে আলাদা থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে একুশ দিনের জন্য। ওরা খায়দায় আর গাঁজার পাতা ঢলে ঢলে রস বের করে নেশা করে পড়ে থাকে। ওরা শহরে থাকতেই নাকি শুনেছে যে ডাক্তাররা গাঁজা গাছ থেকে বানানো একপ্রকার ওষুধ করোনা রোগীদের উপরে পরীক্ষানিরীক্ষা করে কিছু কিছু ফল পাচ্ছে। যাইহোক ওরা তাড়াতাড়ি সেরে উঠুক।তারপর আবার এগাছ থেকে ওগাছ, বিদ্যুতের এই তার থেকে ওই তারে ডানা মেলে উড়ে বেড়াক। কতদিন হয়ে গেল ওরা ঠিকঠাক উড়াল দিতে পারছে না। জমে থাকা খাবার কবেই শেষ হয়ে গেছে। গাছের ছালে ঠোঁট ঘষে ঘষে আর কতদিন চলবে এভাবে!  

সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে থাকা মানুষজনকে ও ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে। মাঝে মাঝে সব্জি বিক্রি করতে আসা অল্প বয়সী কিশোরটিকে সে আগে কখনো দেখেনি, মাসদুয়েক ধরেই দেখছে। ওকে সে জানে না। তবে ওর ডাকটিকে চিনে গেছে। এ বাড়ির মালি, ঝাড়ুদার সবাইকেই চেনে গিরগিটিটি। ওদের কাজের ফাঁকে ফাঁকে জিরিয়ে নিতে বলে সে আর সেই অবসরে ওদের কথা শোনে ঘাড় উঁচু করে, সুখদুঃখের কথা, ঘরসংসারের কথা, অভাব-অনটনের কথা সব। প্রায় দুমাস পর আবার ঝাড়ুদার বুড়োবুড়ি দুজনে আসে কাজে। মুখোশ পড়া কেউ একজন এসে ওর সামনে গাছ ছাঁটার একটা কাঁচি মেলে ধরে।ও ভয় পায় না। মালিকে ও চিনে নেয় আর অনুমান করে দেখে নেয় ওর ফিক করে হাসিটিও। ও জানে মালীটা বড্ড ফাজিল, মাঝেমধ্যে ওকে ভয় দেখাবার জন্য এমন ইয়ার্কি করে। এই বাড়ির মালিক যে কারখানায় কাজ করে সেই কারখানাতেই মালিটি ঠিকা শ্রমিকের কাজ করে। বছরে আট নয় মাসের মতো কাজ পায় আর বাকি সময় এর ওর বাড়িতে মালির কাজ করে সংসার চালায়। তবে এবার লকডাউনের ফলে কোম্পানিতে নাকি অর্ধেক ঠিকাশ্রমিক ছাঁটাই করে দিয়েছে। অর্থাৎ বছরে কাজ পাবে চার-পাঁচ মাসের মতো। আগামি দিনগুলির জন্য তাই সে চিন্তিত। এসব আলাপচারিতার মধ্যেই খুট করে দরজা খোলার আওয়াজ পায় সে। এ বাড়ির কর্তাকে সে বেশ ভয় পায়। এমনি খারাপ না লোকটা তবে লকডাউনের পর থেকে নাকি কোম্পানি স্যালারি অনেক কমিয়ে দিয়েছে, তারপর থেকেই দেখছি কেমন গম্ভীর হয়ে থাকে। ঝাড়ের আড়াল থেকে সে দেখছে কর্তাটি মালি ও ঝাড়ুদারদের গত দু’মাসের বকেয়া টাকা মিটিয়ে দিয়ে আবার ঘরে ঢুকে গেল।

ওর গোপন ডেরা থেকে বেরিয়ে এসে দেখে হালকা হালকা বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। মরসুমের প্রথম বৃষ্টি, বাগানের আগাছাগুলো পরিষ্কারের পর মাটিগুলো অক্সিজেন পেয়ে যেন ভুরভুর করছে। আর সেই সোঁদা গন্ধ বুক ভরে টেনে হাতপা ছড়িয়ে শুকনো শরীরটা মেলে ধরে আকাশপানে। আহা! কি সুন্দর এই জীবন। কি আশ্চর্য এই বেঁচে থাকা। 



Post a Comment from facebook

1 Comments

  1. দারুণ হয়েছে লেখাটা। সবার জানা কথাই একটা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং নিজের-দেখা নিসর্গের এফেক্টে তুলে আনা হয়েছে। ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা এসেছে একটা উদ্দেশ্যকে প্রতিপন্ন করতে। শ্রম, শ্রম-বিভাজন, জড়িত শ্রমিক, তাদের সমস্যা এবং রাষ্ট্রের ভূমিকা এসেছে প্রত্যক্ষভাবে আর নিজস্ব পেশার বিষয়টা এসেছে প্রচ্ছন্নভাবে। বেশ-তো। সবমিলিয়ে ভালো লাগল। ভালো থেকো, শিবু।

    ReplyDelete

Post a Comment

Previous Post Next Post