ব্যাধির
ব্যবচ্ছেদ
অনির্বাণ বটব্যাল
১. প্রাথমিক উপসর্গগুলি
ব্যাধির লক্ষণসমূহ থেকে লক্ষ্য সরে গেলে লক্ষণ রেখাও হারিয়ে যায়। তুমি বুঝতেই পারবে না তোমার গতিবিধি গন্ডির বাইরে না ভিতরে। অবাধ বললেই— ওহে সাবধানী, হিসেবের রাজধানী জুড়ে বেহিসেবি ব্যাধির মহামারী আসলে। হাতে কড় গোনা জীবন আর আয় ব্যায়ের জটিল জটাজুটো মাথায় পরে জটায়ু বাবু যতই সদাশিব সাজুক, যত জট জটায়ুর কপালেই জমল শেষমেশ। জটায়ু বাবু বেশ ছিমছাম সরকারি চাকুরে... গোছানো পরিপাটি। একেবারে হালফিল লাইফস্টাইল। মডেলের নাম— ছোটো পরিবার সুখী পরিবার। হা হা তুমি উপসর্গ খুঁজতে এসে নিজেই ব্যাধির সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললে হে পাঠক। জটায়ু বাবুর আদ্যপান্ত কোনো উপসর্গ নেই বরং জীবন জুড়ে উৎসর্গ জড়িয়ে আছে। এখন তো বুঝেই গেছে লোকে। এটাকে কি যেন বলে... হ্যাঁ হ্যাঁ... এ্যাসিম্পটমিক। জটায়ু বাবু তবে কি প্রচ্ছন্ন উপসর্গ নিয়ে হাঁটছেন জীবনের কিনারা বরাবর ? সমস্ত উপসর্গ নিয়ে বিসর্গ... অতঃপর একদিন চন্দ্রবিন্দু চাঁদ হয়ে যাবেন নাকি নিজের আকাশে...
২. লক্ষণসমূহের চরিত্র বিশ্লেষন বা ব্যাধির বোধিসত্ত্ব লাভ
কিন্তু এবার কি যে হল। সমস্ত লক্ষণ বিলক্ষণ একই চরিত্রের নয়... কেউ খুক করে কাশে তো কেউ ফ্যাঁচ করে হেঁচে দেয়... কোনও দাঁড়িপাল্লাও নেই মানচিত্রও নেই... ব্যাধির বোধিসত্ত্ব হতে গিয়ে শুকিয়ে আমসত্ত্ব হয়ে গেল সব। ধুর আর ভাল্লাগে না। কি যে শুরু হল, সমস্ত হিসাব উল্টে গেল। যদিও জটায়ু বাবুর এই হিসাব আজীবনের। রেলে এই চাকরি পাওয়া থেকেই ট্রেনের মত তারও টাইম টেবিল ছিল ওয়েল মেইন্টেইন্ড। সকালে ওঠা থেকে রাতের বিছানা অবধি তার ছিল মাপা চলাফেরা। অবশ্য বিছানাতেও এই চলাফেরা রুটিন মাফিক কিনা তা তো বলা যাবে না, সে তার চূড়ান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে জীবনের স্টিয়ারিংও ঐ একই থিওরি যতটা চলা ততটাই ফেরা কিন্তু বৌএর কাছে চলা ফেরার হিসাব রাখা ভীষন কঠিন । সেটা জটায়ু বাবু পারেন কিনা জানা নেই। যাই হোক মদ্দা কথা জটায়ু বাবুর মত হিসেবি লোক।
ঘড়ির পিছনে পর্যন্ত লিখে রাখেন ব্যাটারি বদলানোর ডেট-টা। হিসেবের
বাড়ি তার। বাড়ির মার্বেল, রান্নাঘরের কুচিনা, গাড়ির ই এম আই, সব কিছুর ইন্সিওরেন্স
পলিসি, বউ-এর আবদার, ছেলেমেয়ের টিউশানি, বছরে একবার ট্যুর উফফফ...। সবই সেট করে রাখেন... হা হা হা কি আর করা যাবে? সরকারি চাকরি তাও আবার
রেলে। তবু জটায়ু বাবুর জট আরও জটিল ভাঁজ ফেলে দিল কপালে। কোথা থেকে করোনা এল... এটা
কোরো না ওটা কোরো না আবার এক্সট্রা করে এটা কোরো তো ওটা কোরো... ২০ সেকেন্ড হাত ধোয়া,
স্যানিটাইজার মাস্ক আল্টিমেট একটা একটা ছন্দপতন কিন্তু মন্দ পতন মনে হয়নি মোটেই...
সেই যেদিন হঠাৎ একটা লক ডাউন নেমে এল আকাশ বাতাস জুড়ে, রাস্তা ঘাট জুড়ে, বাজার হাট
জুড়ে চাকরি বাকরি জুড়ে টিভি রেডিও জুড়ে আইন আদালত জুড়ে, তার হিসাব একটু কিন্তু কিন্তু
করে নড়ে উঠলেও পরে বেশ সেট করে গেল ব্যালান্স সীটে। পার্টি পলিটিক্সের মতোই কিন্তু
জটায়ু বাবুও এমন লোক নন যে ডাউন হয়ে যাবেন এত সহজেই। নেতাদের মতই উনিও ধরে ফেলেছেন একটা লাভের অঙ্ক লুকিয়ে আছে ভিতরে। জাস্ট ভ্যানিশিং
মেথডের কায়দাটা ঝালিয়ে নিলেই ফায়দা কড়ায় গন্ডায়। কার ঘরে এবং কার ঘাড়ে কখন কেন্দ্র
না রাজ্যকে চাপিয়ে দেবেন তা একটু জাস্ট হিসাবের খাত অদলবদলে খাতা খুলে নিয়েছেন নতুন
ছকে। ছক কষতে কষতে রীতিমত ছক্কা স্পেশালিস্ট জটায়ু বাবুর এখন ওয়ার্ক ফ্রম হোম। কিন্তু
জটায়ু বাবু হিসেবেও গুনে গুনে ছক্কা মারেন একেবারে বাউন্ডারি পার করে দেন। স্কোর বোর্ডে
ওয়ার্ক ফ্রম হোম ছাপিয়ে ওয়ার্ক ফর হোমের রানরেট
বাড়তে থাকে...
বাড়িতে বসেই হোয়াটস অ্যাপের হাজিরা দাও— “আই এন্ড মাই ফ্যামিলি ইস ওওকে” ব্যাস সরকার মাইনে দিতে বাধ্য কারন এটাতো নিজের ইচ্ছায় যাচ্ছি না তা তো নয়, এডমিনিস্ট্রেটিভ অর্ডার ফলো করছি মাত্র। মাইনে কেন দেবে না ? অবশ্য কেউ কেউ রাত দিন কাজ করছে খবর পাচ্ছি এই যে এত অর্ডার বেরোচ্ছে... হসপিটালগুলো কোভিড স্পেশাল হসপিটাল করা হচ্ছে... কেউ কেউ এখন যাচ্ছে বিভিন্ন ওয়ার্কশপে কোয়ারান্টাইন কোচ তৈরী হচ্ছে এসব খবর দেখাচ্ছে টিভি চ্যানেলগুলো। কোভিড নাইন্টিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইন্ডিয়ান রেলের পক্ষ থেকে অবদান... আহা জটায়ু বাবুর এ নিয়ে একটু আধটু গর্বও যে হয় না তা নয়। এই-ত সকাল সকাল এটেন্ডেন্স দিয়েই বেরিয়ে পড়েন থলে হাতে। না সমস্ত প্রশাসনিক বিধি নিষেধ মেনেই বেরোন সমস্ত প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা নিয়েই বাজারে বেরোন তিনি। কি করবেন আর গতকাল রাত থেকেই মেনু ঠিক হয়ে আছে ভুললে চলবে না, অথচ মাথায় আরো গুরুতর চিন্তা আছে... ভারতীয় রেল ব্যবস্থার এ হেন অবদানের একজন প্রতিনিধি তিনি, কত কি যে ভাবেন তার সহকর্মীদের নিয়ে... কি অসম্ভব জীবন বাজী রেখে তারা কাজ করে যাচ্ছে এখনো... পাড়ার দোকানে দাঁড়িয়ে বলেও দেন বেশ কয়েকজনকে... তার মতো দায়িত্ব সচেতন কর্তব্যপরায়ণ সরকারি চাকুরে খুব কমই দ্যাখা যায়... তার বক্তব্যের মধ্যে একটা বেশ দৃঢ়তা ফুটে ওঠে... আসলে এ দৃঢ়তা সেই— যে ছেলেটা ঘরে বসে দিনরাত বিভিন্ন অফিসিয়াল কাজ করে যাচ্ছে নিজের কম্পিউটারে... যারা নিজেদের গাড়ি নিয়ে ডিউটি যাচ্ছে রোগীদের কোচ বানাতে... যারা পণ্যবাহী ট্রেনগুলোকে নিয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের খাদ্য যোগানের জন্য... তারা ছুটে যাচ্ছে সমস্ত সবুজ সিগন্যালে... কোনো কন্টেইনমেন্ট জোন নেই ... রেড জোন নেই ... তাদের সব সবুজ ... সবুজ মানেই তো জীবন... লাইফ ... ইয়েস লাইফ লাইন অফ ইন্ডিয়া ... ইন্ডিয়ান রেলওয়ে... জটায়ু বাবু ফিরে আসেন হন্তদন্ত হয়ে ... খবরটা দেখতে হবে... মাইনেটা ঠিক ঢুকবে তো ... মাস শেষ হতে চলল যে...
৩. সংক্রমণের রেড জোন
আক্রমন থেকে সংক্রমণ অতিক্রমণে সেই চোদ্দ দিনের গেরো। এই চোদ্দর
গেরো থেকে বেরোনো বিরাট কঠিন... জটায়ু বাবু তার চোদ্দ পুরুষের নামে দিব্যি কাটেন আর
খবর নেন আশেপাশে কিংবা কাছাকাছি কোথায় কতদূর এসেছে পজিটিভের খবর... যত নেগেটিভ হয়...
জটায়ু বাবু তত পজিটিভ হয়ে ওঠেন দিনলিপিতে... আর হঠাৎ একদিন হিসেবের খাতায় একদিনের মাইনে
নেগেটিভ হওয়ার খবর এসে গেলো... কিছুই কি করার নেই? অনেক ভেবেচিন্তে দিয়েই দিলেন
পজিটিভ রেসপন্স... করোনা উৎসবে একদিনের মাইনে তার চাঁদা... কত প্রতিবাদ পোষ্টার এল তার
হোয়াটসঅ্যাপে... না আর কোনো কর্ণপাত নয় দেশের বিপদ জাতীয় বিপর্যয়... জটায়ু বাবুর
দেওয়া উচিত আর তাছাড়া সবাই জেনে গেলে কি হবে
যে উনি দিতে নারাজ হয়েছেন... বরং উনি গর্বিত... এখন আর পজিটিভকে ভয় পান না... শুধু দুশ্চিন্তা সংক্রমণ কোথায় কত গভীরে। তার ঘরের আনাচে কানাচে উনি সংক্রমণ আঁচ
করছেন... সংক্রমণ ক্রমশ ফাঁস হয়ে বসে যাচ্ছে তাবৎ পৃথিবীর মানব সভ্যতার দেহে... অর্থনীতির
খাঁজে খন্দরে... ত্রাণ বিলির মরশুম নেমে এসেছে এখন। রাস্তায় নেমে এসেছে মানুষের
ঢল... সবাই ফিরতে চায় ঘরের কাছে... নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের কাছে আরো কিছুদিন বাঁচার কাছে...
নিদেনপক্ষে প্রিয়জনের কোলে মরার কাছে... ফেরা
মানে কি আদৌ তাই? বরং বেওয়ারিশ লাশ হওয়ার ভয় এখন। পৃথিবীও ফিরে যাচ্ছে আদিমতায়... গৃহবন্দী
হও মানুষ গুহাজীবনে ফেরো... রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছে যাদের বন্য ভাবতে এতোকাল... এ এক উলটো
চিড়িয়াখানার যুগ... খাঁচায় বন্দি মানুষকে দেখতে আসছে জন্তু জানোয়ার... জটায়ু বাবু ফিরে
যাচ্ছেন ছেলেবেলার হিসাবে... খুব মাপা পয়সা মাপা খরচের সংক্রমণ এখন তার হিসাবের খাতায়...
ডি এ বন্ধ আগামী একবছর... হিসেব করে দেখে নিয়েছেন প্রায় হাফ পে হয়ে গেল পনেরো দিন...
আর পজিটিভ নয় ক্রিয়েটিভ হয়ে উঠলেন... এক্সট্রা
এ্যাক্টিভ হয়ে উঠলেন... রেডিও এ্যাক্টিভ বিচ্ছুরণে মিলিয়ে নিচ্ছেন নতুন হিসাব... করোনার
জন্য কাজের লোক বাদ... মেয়ের টিউশানি খরচ বাদ... পুল কারের খরচ বাদ ...
বাদ বাদ... আর বাদানুবাদ। মতবাদ... অনুবাদ... কিছু বাকি নেই
বরং সংক্রমনের জিন্দাবাদ বলো সবাই। শুধু বরবাদ একদেশেরই কিছু লোক, পরিযায়ী হয়ে যাচ্ছে
হাঁটতে হাঁটতে... বিশেষজ্ঞ বদলে যাচ্ছে ঘন্টায় ঘন্টায়...
পরিযায়ী উড়ে আসছে দলে দলে... হাইরোড ধরে ... রেল লাইন ধরে...
দিনের আলোয় রাতের অন্ধকারে... ঘুমিয়ে জেগে খেয়ে না খেয়ে... গন্তব্য ছিল... আশা ছিল...
ভরসা ছিল... আর কিছু রুটি ছিল গামছায় বাঁধা ছিন্নভিন্ন হওয়ার আগে ...
পরেরদিন সকালে ওই রুটিগুলোই সেলিব্রিটি... পেপারে টিভিতে খবরে
রুটিগুলোকে দেখাচ্ছে... পরিযায়ী রক্তে ভেজা লাল রুটি... পড়ে রয়েছে রেল লাইনের মাঝখানে
... লাইফ লাইন অফ ইন্ডিয়ার মাঝখানে... যে লাইন কোনোদিনই ওদের গন্তব্যে পৌঁছবে না...
ক্ষুধার্ত জঠরে পৌঁছে দেবে না... পৌঁছে দেবে না ডানা ভাঙ্গা পরিযায়ীকে তার বাসায়
...
ছবিটা মোটেই খুশি করেনি জটায়ু বাবুকে... তার হিসাবের তাল কেটে গেল। পেপারটা লুকিয়ে রাখেন তাড়াতাড়ি। মেয়ে যদি বায়না ধরে, যদি জিজ্ঞেস করে— ও বাবা রেল লাইনে লাল রুটি পড়ে আছে কেন? তুমি তো রেলে চাকরি করো
... বলো না ... ও বাবা ... প্লিজ ...
অনির্বাণ অনির্বাণ
ReplyDeleteভালো লাগল। সাম্প্রতিকের সঙ্গে নিজস্ব মনের মাধুরী মিশায়ে এই লেখা। ভালো থেকো, বটুক।
ReplyDeletePost a Comment