নিজেরাই প্রাপ্য
করে নিয়েছি
প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য
আমি একদমই প্রস্তুত
ছিলাম না। মাস ছয়েক হল একটা ছবি রিলিজ (রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত, সেপ্টেম্বর, ২০১৯)
করেছিল। আরও বিভিন্ন পরিকল্পনা করছিলাম। ছোট ছবি, বড় ছবি, সিরিজ ইত্যাদি করার। সম্পাদনা,
লেখালেখি, পড়ানোর কাজকম্মো ছিল। করোনা, করোনা শুনছিলাম। এরম কতই তো শুনেছি। ইবোলা,
সার্স, মার্স। কোনও কিছুই আমাদের দেশে সেরম প্রভাব ফ্যালেনি। সুতরাং খানিক নিশ্চিন্তই
ছিলাম বলা যেতে পারে।
লকডাউন হল। তার দিন
দশ আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল আমরা খুব একটা শান্তিতে থাকতে পারব না। বিভিন্ন বাড়িতে যথাসম্ভব
চাল, ডাল, তেল মজুত করে রাখা হচ্ছিল। আমিও করেছিলাম। দোকানে অনেক কিছুই পাওয়া যাচ্ছিল
না। লোকে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন।
হঠাৎ করে হাতে কোনও কাজ নেই। বাধ্যতামূলক অবসর। প্রথম দিকে থালা বাজানো বাটি বাজানো এসব দেখে দিন চলে যাচ্ছিল
ঘরবন্দী অবস্থায়। খানিকটা বিশ্রামও পাচ্ছিলাম বলা চলে। টেলিভিশানে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ
নিদান দিচ্ছিলেন একুশ দিন লাগবে, উনপঞ্চাশ দিন লাগবে। আমরাও ভেবে নিয়েছিলাম এই কদিন
বন্দী থাকলেই করোনার থেকে মুক্তি। আমাদের হর্তাকর্তাবিধাতারাও বোধ হয় তাই ভেবেছিলেন। ভিন রাজ্যে যারা কাজ করতে
গেছেন, বা চিকিৎসা করতে গেছেন বা বেড়াতে গেছেন তাদের কথা কারওরই মাথায় আসেনি।
এমনিতে কাজ না থাকলে
আমি খুবই কুঁড়ে লোক। বহুদিন ছবি দেখা হয় না। ভাবলাম এবারে ছবি দেখবো অনেক। ওয়েব সিরিজ
দেখবো। তা দেখলামও বেশ কিছু। বই পড়লাম । প্রথম দিকে চিত্রনাট্য লেখার কথা মনে হয়নি।
শুনলাম অনেকেই লিখছেন এই অবসরে। লেখার চেষ্টা করলাম। হল না। করোনা মাথায় গিজগিজ করছে।
যাই লিখি করোনার রেফারেন্স চলে আসছে। তো আমি যেরম মোবাইলে ভিডিওছবি বানাই সেরম একটা
ভিডিও বানালাম প্রথম দিকে। লিঙ্ক রইল।
ট্রেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কলকাতায় আমাদের কাজের দিদিরা আসেন লক্ষ্মীকান্তপুর লাইন থেকে। তাঁরা আর আসতে পারলেন না। বাড়িতে মা, বাবা আর আমি। মা একাত্তর, বাবা ছিয়াত্তর। বাড়ির কাজ করা শুরু করলাম। কলকাতায় প্রথম এসে মেসে থাকার সুবাদে নিজের কাজ নিজে করার অভ্যেস ছিল। ঘর ঝাঁট দেওয়া, মোছা, জামাকাপড় কাচা ইত্যাদি করতে শুরু করলাম। কিন্তু রান্নায় সাহায্য করতে যাওয়ার ব্যাপারে মায়ের আপত্তি ছিল এবং এখনও আছে। চা করা অবধি ঠিক আছে। আমার রান্না খুব খারাপ, এ ছাড়াও অন্য কারণ হচ্ছে রান্নাঘর মায়ের , আমি অনুপ্রবেশকারী।
ধীরে ধীরে সময় বয়ে
যেতে লাগলো । লকডাউনও বাড়তে লাগলো। বিভিন্ন ভয়ানক মৃত্যু এবং মৃত্যু পরবর্তী খবর আসতে
শুরু করলো বিভিন্ন মিডিয়ায় এবং অবশ্যই সোশ্যাল মিডিয়ায়। রোগ ছড়ানোর খবর আসতে শুরু করলো।
বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী মতামত, নিদান এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া ও দেওয়া শুরু হল (যা আজকের
তারিখেও হচ্ছে)।
আমরা বুঝতে পারছিলাম
একে অপরের উপর কতটা ডিপেন্ডেন্ট। এই জায়গাতে আমি খানিকটা কনফিউজডও বটে। আমাদের একটা
রিয়েলাইজেশান হচ্ছিল, সমাজে সবাই সবার উপরে ডিপেন্ডেন্ট। আবার একই সঙ্গে লকডাউন আমাদের
শুধু নিজেদেরটুকু নিয়ে বেঁচে থাকা অভ্যেস করাচ্ছিল যা হয়তো গত চল্লিশ পঞ্চাশ বছর ধরেই
আমাদের মনের সুপ্ত ইচ্ছে। বাবা এবং মায়ের সঙ্গে
সময় কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে এই বিশ্রাম আর ফেসবুকীয় কলতলা (যাতে আমিও অংশ নিয়েছি)
অসহনীয় হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। মা, বাবার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছিলাম। বিভিন্ন লোকের সমস্যা
শুনতে পাচ্ছিলাম। আর্থিক, মানসিক, শারীরিক। আমার নিজেরও সমস্যা হচ্ছিল। আমার প্রিয়তম
মানুষটির সঙ্গে দেখা হচ্ছিল না। আমার ছোট্ট আদরের সঙ্গে দেখা হচ্ছিল না। বন্ধুবান্ধব,
আত্মীয়স্বজন মিলে যে সামাজিক জীবন কাটাই তা সম্পূর্ণ বন্ধ। কাজকম্মো নেই।
এসব আমি কিছু কিছু
পড়েছি। কিছু সিনেমা দেখেছি। প্লেগ, ফ্লু, যুদ্ধ, মন্বন্তর, মহামারী। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় প্রথম। তবুও সব কিছু ভুলে নিজেদের মত করে মানিয়ে নেওয়ার
চেষ্টা করছিলাম। আবার একটা ভিডিও বানালাম তখন।
এরপর এলেন পরিযায়ী শ্রমিকেরা। যাঁদের এত চমৎকার নাম শুনলাম (পরিযায়ী শ্রমিক) এবং সবাই মিলে ওঁদের কথা বলতে শুরু করলাম (লকডাউনের শুরুতে আমি কিন্তু ওঁদের কথা ভাবিনি)। আমরা যেসব দৃশ্য দেখতে শুরু করলাম তা অভূতপূর্ব আমাদের জীবনে। এবং প্রতিদিন প্রতিঘন্টায় আমরা যে ছবি দেখতে শুরু করেছিলাম তা আমাদের নাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু দুই এক দিনের মধ্যেই এই ছবিগুলোই যেন আমরা দেখার অভ্যেস করে নিলাম। এবং যোগ দিলাম বিভিন্ন রাজনৈতিক তরজায়। দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল ধর্মে। এবং জাতে। আমরা সেই ধর্ম ধর্ম খেলায় মেতে উঠলাম। ফেসবুকে, টুইটারে, ইন্সটাগ্রাম ইত্যাদি এবং অবশ্যই টেলিভিশান এবং প্রিন্ট মিডিয়ায়। আমাদের মাথার উপর ছাদ ছিল, পেটে খাবার ছিল এবং মোবাইলে ইন্টারনেট ছিল। দুপুরবেলায় ভরপেট খাওয়াদাওয়া করে বেশ শুয়ে শুয়ে দেখতাম একটি বাচ্চা তার মৃত মা কে জাগানোর চেষ্টা করছে। ভিডিও দেখলেই নাম জানার চেষ্টা করতাম। কোন ধর্ম। কি জাত। এখন মনে হয় আমাদের অন্যতম চাহিদা হয়ে দাঁড়িয়েছে সেকেন্ডে সেকেন্ডে আড্রিনালিন ক্ষরণ।
এরপর এলো ঝড়। আম্ফান। আম্ফান আসায় বোঝা গেল পরিযায়ী শ্রমিক খেতে না পেয়ে মৃত্যু বরণ করলে ফেসবুকে দুকলম লিখলে কাজ চলে যায়। কিন্তু নিজের বাড়িতে দিনের পর দিন কারেন্ট, জল এবং ইন্টারনেট না থাকলে রাস্তায় নামা দরকার। ছাত্রছাত্রীরা কেন বারবার করে রাস্তায় নামেন তা নিয়ে আমরা বরাবর নাক কুঁচকিয়ে এসেছি। আশা করি এই ঘটনা মনে থাকবে আমাদের। সুন্দরবনে ম্যানগ্রোভ রক্ষা করা দরকার। একথা এতদিন যারা বলে আসছিলেন তাঁদের কথায় আমি বিন্দুমাত্র পাত্তা দিইনি। যদিও কারেন্ট এবং ইন্টারনেট আসামাত্র আমরা আম্ফানে যারা ক্ষতিগ্রস্ত তাঁদের সাহায্য করতে শুরু করেছি হাতের মুঠোর ইন্টারনেট পে দিয়ে। এবং আবারও মনে করতে শুরু করেছি হাতের মুঠোর ইন্টারনেট পে সব ঠিক করে দেবে। আমরা বারবার ভুলে যাই মানুষের একটু সম্মানও লাগে। শুধু টাকা দিলে সব মিটে যায় না। ছাত্রছাত্রীরাই আমাদের ঠিক পথে চালিত করতে পারেন বলে মনে করি।
আমাকে অনেকেই বলেছেন এইসব বিষয় নিয়ে ছবি বানাতে। অথবা (এই নিয়ে
না হলেও) কাজকম্মো শুরু হলে ওয়েব সিরিজ বানাতে, ছবি বানাতে। আমি ঠিক নিশ্চিত নই তা
আমি করতে পারবো কিনা। ভাবনাচিন্তা খুবই অস্থির, জড়িয়ে পেঁচিয়ে আছে।
আপাতত পড়ানোতে (সিনেমা
সংক্রান্ত) মন দিয়েছি। এবং সাইকেল চালানোয়। আমি এতে মুক্তি খুঁজে পাই।
শৈশব, কৈশোরেই মুক্তি
মনে হয়।
আশার কথা, এই দুঃসময়ে,
কিছু মানুষ আছেন যাঁদের জন্য মনে হয় এখনও কিছু করা যায়। বারবার মনে দানা বাঁধে ভালোবাসার
কথা, বন্ধুত্বের কথা। এবং অবশ্যই সিনেমার কথা। সিনেমা বানানোর ইচ্ছের কথা।
যাকগে আপাতত শেষ
করি।
এই লেখার শেষে মাসখানেক
আগে লকডাউনে আমার বানানো শেষ ভিডিও রইলো।
ভালো থাকবেন।
ইতি প্রদীপ্ত
পুনশ্চ - এই জটিলতা,
এই ধ্বংস আমাদের প্রাপ্য ছিল না। আমরা নিজেরাই
প্রাপ্য করে নিয়েছি।
ভালো লাগলো। বেশ ভালো, যাকে বলে। কলম সরুক আরও, উদ্ভুত ও অনিয়ন্ত্রিত এই সমস্যাজনিত ব্যক্তিক অনুভবের রাশিমালাকে আলোকিত করে, যা মনন ও খাতা-কলম থেকে শুরু করে তার যাত্রা শেষ করবে পর্দায়। অভিনন্দন। ভালো থাকুন।
ReplyDeletePost a Comment