লকডাউন
শুভাঞ্জন সেনগুপ্ত
“হ্যালো, কেমন আছিস? বাড়িতেই আছিস তো?”
“আর কোথায় যাবো! এখন তো লকডাউন চলছে”
‘লকডাউন', শব্দটা প্রথম জানলাম, 24 শে মার্চ 2020
যখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী মাননীয় শ্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করলেন পুরো দেশের লকডাউন
এর কথা।
লকডাউন এর আভিধানিক অর্থ হলো— The
confining of prisoners to their cells, typically in order to regain control
during a riot. আবার মতান্তরে— A state of isolation or restricted access
instituted as a security measure.
মনে হচ্ছিল অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে আমরা সবাই চলে যাচ্ছি। বাঁচবো তো!!
সবাই ভীত, সন্ত্রস্ত। বাড়িতে থাকতে হবে। নতুন এক ভাইরাসে আক্রান্ত হবার প্রবল সম্ভাবনা যার নাম— করোনাভাইরাস। সুতরাং সিদ্ধান্ত হল বাড়িতেই থাকতে হবে। থাকব তো! কিন্তু কতদিন?
আমার কর্মক্ষেত্র আদালত। আমি পেশায় একজন আইনজীবী। করোনাভাইরাসের হুঙ্কারে বন্ধ হয়ে গেল সমস্ত কিছু। এমনকি যানচলাচলও স্তব্ধ হয়ে গেল।
সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী বাড়িতেই থাকা শুরু। প্রথম প্রথম বেশ ভালোই লাগছিল। মনে হচ্ছিল ছুটি কাটাচ্ছি। কিন্তু যত দিন যেতে লাগল, ততই ব্যাপারটা অসহনীয় হয়ে উঠছিল। কোন কাজ নেই, প্রয়োজন ছাড়া রাস্তার মুখ দেখা সম্পূর্ণ বন্ধ। মানুষ দিশেহারা। প্রকৃতির এই মারণ রোগের কাছে মানুষ অসহায়। বাইরে বেরোনো বন্ধ মানেই মেলামেশা বন্ধ। ক্রমে ক্রমে মানুষ
নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছিল যার প্রভাব স্পষ্টভাবে পড়ছিল আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে। “কি করব, কোথায় যাব, কাল কি হবে” —এই সবই ছিল মানুষের
মনের জিজ্ঞাসা। এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে সবাই চলে যাচ্ছিলো। জীবন, ভাইরাসে শেষ হবে, নাকি অনাহারে —এই প্রশ্নই হয়ে ওঠে বীজ মন্ত্রের মতো।
পৃথিবীর সমস্ত উন্নত দেশে প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে আক্রান্তের
হার, সেইসাথে পাল্লা
দিয়ে এগিয়ে চলে মৃত্যু মিছিল।
এই মহামারী বাধ্য করেছে সমস্ত কাজ, চলাফেরা, ব্যবসা, মানুষের অধিকার ইত্যাদি সমস্ত কিছু থেকে মানুষকে বঞ্চিত
করতে।
বলাবাহুল্য ভারতবর্ষের সমস্ত আদালত এই আবহে বন্ধ। বিচারব্যবস্থা বন্ধ মানেই দেশের সংবিধানকে নরকের প্রান্তে ঠেলে দেওয়ার সামিল। প্রায় সব বিষয়ে আদালতের হস্তক্ষেপ অনস্বীকার্য। সাংবিধানিক সংকটে সর্বোপরি প্রয়োজন আদালতের এবং আইনজীবীদের। শুরু হলো নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা সেই সঙ্গে শুরু হলো নতুন
নতুন চিন্তা ভাবনা। চেষ্টা হলো e-filing অর্থাৎ ইন্টারনেটের মাধ্যমে মোকদ্দমা
দাখিল, ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শুনানি। কিন্তু সেরকম ভাবে কোনটাই খুব
ফলপ্রসূ হলো না। যার ফলে আদালতের স্বাভাবিক কাজকর্ম অনেকাংশে
ব্যাহত হতে থাকলো। আদালত বন্ধ —এটাই সাধারণের কাছে একটা ধারণা
জন্মালো।
একটা দমবন্ধ করা পরিস্থিতি। কোন কাজ নেই। খাওয়া, বসা, ঘুমোনো এই হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের দৈনন্দিন রুটিন।
আগেই বলেছি প্রায় সব বিষয়ে আদালতের হস্তক্ষেপ অনস্বীকার্য। তেমনি এই লকডাউন এর মধ্যে উঠে এল এক হাড়হিম করা ঘটনা। অর্থ রোজগারের জন্য, সংসার প্রতিপালনের জন্য বিভিন্ন রাজ্যের
শ্রমিকদের পাড়ি দিতে হয় অন্য রাজ্যে। এই লকডাউন এ সেই সমস্ত খেটে
খাওয়া মানুষেরা যাদেরকে পরিযায়ী শ্রমিক অথবা migrant workers বলে অভিহিত করা হলো তাদের না
থাকলো কাজ, অর্থ, খাবার, বাসস্থান। ফলত তারা প্রত্যেকেই চাইল যেভাবেই হোক বাড়ি
ফিরতে হবে। শুরু হলো বাড়ি ফেরার লড়াই। কেউ হেঁটে, কেউ রেললাইন ধরে শুধুই চলতে লাগলো। তারা জানে না এ চলার শেষ কোথায়। কেন্দ্রীয় সরকারের আদেশ
অনুযায়ী বিভিন্ন রাজ্যের বর্ডারে তাদের আটকে দেওয়া হতে থাকলো। এমনকি কারোর কারোর প্রাণও বিসর্জন দিতে হলো। Disaster
Management Act-এর সঠিক প্রয়োগ আবশ্যিক হয়ে পড়ল। ঠিক তখনই ভারতের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট আদেশ দিলেন যে
সমস্ত রাজ্যকে পরিযায়ী শ্রমিকদের নিখরচায় বাড়ি ফেরাতে হবে এবং তাদের দেখভাল
করতে হবে।
এটাই হচ্ছে ভারতীয় বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপ এবং সক্রিয়তা। যা কিনা সমস্ত ভারতবাসীর কাছে আজও শেষ আশ্রয়স্থল। যার ফলে যারা ভেবেছিল আর কোনদিন বাড়ি ফিরতে পারবো না তারা
বাড়ি ফিরে এলো।
আমাদের এই আবহেই থাকতে হবে। আমরা সকলেই যদি একটু হ্যাঁধর্মী
হয়ে উঠতে পারি তাহলে আমরা আমাদের বাঁচার রসদ ফিরে পাবো। লড়াই করার মানসিকতা আমাদের মধ্যে জন্মাবে, আমাদের মন থেকে
কুচিন্তা অনেকাংশে দূরীভূত হবে। আমাদের শপথ হবে— যতদিন বেঁচে আছি
মরবো না কিছুতেই আমরা।
“Things done well and with care exempt themselves from
fear” —William Shakespeare.
Things will get better. It may be stormy right now, but
it can never rain forever. আমাদের শপথ, আমরা বাঁচবো, আমাদের বাঁচতেই হবে। সেই সঙ্গে বাঁচাতে হবে আমাদের ধরিত্রীকে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলি— “Clouds come floating into my life, no longer to carry rain or usher storm, but to add colour to my sunset sky”
ভালো লাগল। নিজস্ব ব্যবসায় সম্পর্কেও কিছু কথা আছে, যা জরুরি। ভালো থেকো।
ReplyDeletePost a Comment