করোনাভাইরাস ও আজকের পৃথিবী, এক তথ্যমূলক পর্যালোচনা
হিন্দোল গঙ্গোপাধ্যায়
-
কিরে, যাবি তো?
-
হ্যাঁ, যাব না কেন?
-
তোর ‘ডোন্ট ডু’ এর ভয় নেই?
-
সেটা আবার কি?
-
আহা বাংলা কর না
-
ও আচ্ছা। না সেসব কোন ভয় নেই
-
সুপ্রিয়দারা তো ক্যানসেল করেছে। বাচ্চা নিয়ে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের রিস্ক ওরা নেবে
না
-
হ্যাঁ, সে তো শুনলাম। কিন্তু মনে হয়না এতটা ভয় পাওয়ার মত কিছু আছে বলে
কথা হচ্ছিল জানুয়ারির মাঝামাঝি। আমাদের ব্যাঙ্গালোরে নাটকের যে দলটির সঙ্গে আমি যুক্ত, তার প্রতি বছর একটা করে বাইরে যাওয়া বা আউটিং এর আয়োজন করা হয়, সাধারণত পাহাড় ও হাল্কা ট্রেকিং এর সুবিধাসহ। এবারেও সেরকমই প্ল্যান ছিল। পছন্দ করা হয়েছিল এক পাহাড়ি ছিমছাম জায়গা, আর যাওয়ার জন্য সবাই ছিলাম উদগ্রীব। যা নিয়ে সেদিন মজা করেছিলাম বা হাল্কাভাবে কথা বলেছিলাম, কে জানত আগামী একমাসের মধ্যেই এই করোনা ভাইরাসের ত্রাসে শুধু গোটা দেশ নয়, গোটা বিশ্ব স্তব্ধ হয়ে যাবে, ধনতান্ত্রিক আমেরিকা বা চিকিৎসাশাস্ত্রে উল্লেখযোগ্য পরিকাঠামোসহ ইতালির মত দেশগুলি এভাবে আত্মসমর্পণ করবে, অনিশ্চিত হয়ে যাবে বাড়িতে বসে কাজ করার মেয়াদ, বহু মানুষ কাজ হারাবেন, প্রান্তিক মানুষের কাছে ক্রমশ অসুগম হয়ে উঠবে প্রয়োজনীয় তৈজসের সরবরাহ।
২৯শে ডিসেম্বর, ২০১৯, চিনের ডাক্তারি অধিকর্তারা ইউহান শহরে নিউমোনিয়া-সদৃশ রোগে আক্রান্ত রোগীর আধিক্য (reported cluster of related pneumonia cases) লক্ষ্য করলেন। ইউহান, হুবেই'এর রাজধানী, জনসংখ্যা প্রায় ১১ মিলিয়ন। যথেষ্ট পরীক্ষানিরীক্ষার পর খোঁজ পাওয়া গেল এক ভাইরাসের। সাধারণত যে ভাইরাস যে রোগ ছড়ায় বা শরীরের যে জায়গায় আক্রমণ করে, তদানুরূপ ভাইরাসের নামকরণ করা হয়। যেমন হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস বা HIV মানুষের শরীরে অ্যাকিউট ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোম বা AIDS এর জন্ম দেয়। এই ভাইরাসটিকে বিশ্লেষণ করে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন আর ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অফ ট্যাক্সোনমি অফ ভাইরাসেস, SARS-CoV-2 গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করলেন। SARS (সার্স) অর্থে সিরিয়াস অ্যাকিউট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম, যেহেতু এই ভাইরাস প্রথমেই আক্রমণ করে ফুসফুস ও স্বরযন্ত্রকে। চিনের বাইরে ১৩ই জানুয়ারি থাইল্যান্ডে ও ১৬ই জানুয়ারি জাপানে এই ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের খবর মেলে। ২৩শে জানুয়ারি থেকে চিন সরকার ইউহান ও অন্যান্য শহরকে লকডাউনে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, আর দেশ নির্বিশেষে সারা বিশ্বে ক্রমশ বাড়তে থাকে করোনা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা। মার্চ ২০২০ তে WHO এই রোগকে গ্লোবাল প্যানডেমিক বলে ঘোষণা করে।
সংখ্যাতত্ত্বের নিরিখে এই পৃথিবীব্যপী অতিমারি বহু বিশ্লেষণের রাস্তা খুলে দেয়। এর আগে অন্যান্য মহামারি ইতিহাস প্রত্যক্ষ করলেও এই করোনা ভাইরাস জনিত দুঃসময় ২০০৮ এর গ্রেট ডিপ্রেশন বা ইবোলা ভাইরাস সংক্রমণকালের ভয় ও ক্ষয় দুইই ছাড়িয়ে গেছে। ওয়ার্ল্ডোমিটারের (https://www.worldometers.info/coronavirus/) তথ্যানুযায়ী, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে (২০জুন, ২০২০) পৃথিবীতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৮৭লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে, মারা গেছেন সাড়ে চার লক্ষের বেশি মানুষ। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসতে পেরেছেন প্রায় ৪৬লক্ষ মানুষ। দৈনিক গড় মৃত্যুর হার বিশ্বজুড়ে প্রায় ছহাজারের কাছাকাছি হলেও, পূর্ববর্তী মাসগুলিতে এই হার দৈনিক প্রায় সাড়ে সাত থেকে আট হাজারের কাছাকাছি ছিল। এই খবর সামান্য সূর্যালোক বয়ে আনলেও ভিন্ন ভৌগলিক মানচিত্রে ঘেরা বিভিন্ন দেশের সব ক্ষেত্রেই একই সামঞ্জস্য রেখে যাচ্ছে, তা নয়। প্রাথমিক ভাবে ইউরোপীয় দেশগুলির ওপর করোনা মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল, কিন্তু ফ্রান্স ইতালি জার্মানি ইত্যাদি দেশে অবস্থা এখন কিছু স্থিতিশীল, এমনকি করোনার জন্মস্থান ও একদা সর্বোচ্চ আক্রান্ত সংখ্যায় জর্জরিত চিনও পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে৷ কিন্তু উত্তর আমেরিকা, ব্রিটেন আর সুইডেনে এখনো উচ্চমাত্রায় করোনা আক্রান্তের খবর পাওয়া যাচ্ছে, আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে দক্ষিণ আমেরিকায়। পেরু চিলি ব্রাজিল বলিভিয়া এই দেশগুলিতে বৃদ্ধির হার এক্সপোনেনশিয়াল (হার যেখানে সরলরৈখিক নয়)। চিলির মোট জনসংখ্যার প্রায় ১% করোনা আক্রান্ত, এবং গত সপ্তাহ থেকে প্রতি মিলিয়নে গড়ে আটজন মানুষের দৈনিক মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে এই দেশটি থেকে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ এবং উদ্বেগজনক। কাতারে প্রতি মিলিয়নে আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ক্রান্তীয় অঞ্চল ও দক্ষিণ গোলার্ধে আক্রান্ত সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। ইরান ও সিঙ্গাপুর করোনার দ্বিতীয় স্তরের মুখোমুখি হয়েছে, ইরানে সংখ্যা বাড়লেও সিঙ্গাপুর পরিস্থিতি কিছু নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে, মে মাসের শেষ পর্যায় থেকে এইদেশে আক্রান্ত সংখ্যা ক্রমশ কমতির দিকে গিয়েছে।
করোনা ভাইরাসের হানা সবচেয়ে বেশি প্রকট হয়ে উঠেছিল মার্চ মাসে। বিশ্বের সব ক্ষেত্রে সমস্ত প্রয়োজনীয় পরিষেবা অপ্রতুল হয়ে পড়েছিল। চিকিৎসার সুবিধা ক্রমবর্ধমান রোগীর তুলনায় ছিল অল্পতর, বহু বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন, অস্থায়ী শ্রমিক, ঠিকে কর্মচারী এমনকি বেশ কিছু ক্ষেত্রে স্থায়ী কর্মচারীরাও। বহু কর্মক্ষেত্র থেকে কর্মচারীদের বলা হয়েছে ৮০% মাইনে নিতে ও সপ্তাহে একদিন কম কাজ করতে; সেক্ষেত্রে প্রতি সপ্তাহে একটি করে দিন কর্মনাশা ও দৈনিক বেতনবিহীন দিন, কর্মচারীরা রাজি না থাকলেও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। স্টক মার্কেট বা শেয়ার বাজারের জন্য মার্চ মাস ছিল অভিশাপের মত। বিশ্বের অন্যতম নামী সংস্থা নিউক্লিয়াসওয়েলথ, যাঁরা স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যানালিসিস ও মডেলিং এর মাধ্যমে দীর্ঘদিন নির্ভরযোগ্য প্রেডিকশন দিয়ে আসছেন, শেয়ার বাজারের ক্ষেত্রে তাদের গণনা মার্চ মাসে ৭.৩% নেমে যায়। গোটা পৃথিবীতে শেয়ার বাজারের প্রায় ২০% অবনমন লক্ষ করা যায় এই সময়ে। তর্কাতীতভাবে নেমে গেছে ইউরোপীয় দেশগুলির জিডিপির হার। অর্থনৈতিক সূচকের অন্যতম বড় মাপকাঠি তেল ও জ্বালানির বিক্রি যথেষ্ট কমে যায় কারণ সমস্তরকম যাতায়াত বন্ধ রাখা হয়েছিল। তেল ছাড়া ন্যাচরাল গ্যাসের চাহিদাতেও অবনতি লক্ষ্য করা যায়। ভারী শিল্পে প্রয়োজনীয় ধাতুর চাহিদা পৃথিবী জুড়ে নেমে যায় কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য। ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড এর বয়ান অনুযায়ী, সরবরাহ সমস্যা, সীমান্তে বিলম্ব, খাদ্যের মান পরীক্ষা ইত্যাদি কারণে খাদ্যসঙ্কট দেখা যায়। দক্ষিণ কোরিয়াতে অর্থনৈতিক ও ব্যাবসাজনিত কর্মকাণ্ড পুরোপুরি স্তব্ধ হয়নি, তাই অর্থনৈতিক মন্দার কুপ্রভাব এই দেশ কিছুমাত্রায় নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে।
করোনা
এখনো অবধি ২০০র কাছাকাছি দেশ ও ২৭০টি ভিন্ন ভৌগোলিক ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে। উঠে
এসেছে সেইসংক্রান্ত বহু তথ্য, যা রাশিবিজ্ঞানী বা স্ট্যাটিস্টিশিয়ানদের জন্য
বহুমুখী বিশ্লেষণের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে৷ প্রতিদিন বিভিন্ন আক্রান্ত অঞ্চল থেকে
মোট রোগীর সংখ্যা, তাদের লিঙ্গভিত্তিক বিভাজন, অঞ্চলটির বিভিম্ন বৈশিষ্ট্য যেমন কি
দেশ কি মহাদেশ, ক্রান্তীয় বা বিষুব অঞ্চল, শীত না গ্রীষ্মপ্রধান, খাদ্যাভ্যাস কি,
মানুষের পার ক্যাপিটা ইনকাম বা মাথাপিছু আয় কত, চিকিৎসার পরিকাঠামো কেমন, প্রতি
হাসপাতাল পিছু কত শতাংশ আইসিইউ বা ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট ব্যবহার করা যাবে, কতজন
মৃত, কতজন আশঙ্কাজনক অবস্থায় আক্রান্ত, বয়সপিছু রোগীর তালিকা এরকম আরও বহু সূত্র
থেকে তথ্যসংগ্রহ করা যায়। ওয়ার্ল্ডোমিটার এবং জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি অফ মেডিসিন
এবিষয়ে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্যাদির জোগান দেয়। উল্লিখিত সমস্ত তথ্যই র-ডেটা (raw
data), বা কেবল সংগৃহীত তথ্য, যা ব্যবহার করে আরও অনেক ক্যালকুলেটেড ডেটা ফিল্ড
তৈরী করা যায়, যা তুলে ধরা যেতে পারে বিভিন্ন সূচক বা কেপিআই (KPI - Key
Performance Indicator) হিসেবে। যেমন, শুধু অঞ্চলপ্রতি মৃত মানুষের সংখ্যা দেখে
আমাদের কিছু ধারণা হতে পারে, কিন্তু যদি আমরা প্রতি অঞ্চলের ভিত্তিতে দৈনিক
মৃত্যুর বৃদ্ধির হার কষে বের করতে পারি তবে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হতে পারে,
যার মান ধনাত্মক হলে আতঙ্কের, ঋণাত্মক হলে স্বস্তির। ধরা যাক প্রথম পাঁচদিনে কোন
অঞ্চলে মৃত্যুর সংখ্যা (২,৫,৭,৮,৬), তাহলে সেক্ষেত্রে দিনপ্রতি ওই অঞ্চলের মৃত্যুর
হার হবে যথাক্রমে (০%, ১৫০%, ৪০%, ১৪% এবং -২৫%), কারণ আমরা জানি বৃদ্ধি/হ্রাসের
মান নির্ণয় করতে হয়
{(আজকের মৃতসংখ্যা-কালকের মৃতসংখ্যা)/কালকের মৃতসংখ্যা} এই সূত্র ব্যবহার করে। এইভাবে গোটা মাসের জন্য আমরা অঞ্চলপ্রতি একটি সংখ্যামালা বা শতাংশমালা (পার্সেন্টেজ সিরিজ) পেতে পারি, যা গ্রাফে তুলে ধরলে মৃত্যুর হার সম্পর্কে স্পষ্ট একটি ধারণা পাওয়া যাবে। আবার, প্রথমদিনের নিরিখে কত শতাংশ মৃত্যু বৃদ্ধি বা হ্রাস হল, তারও হিসেব পাওয়া যাবে, এক্ষেত্রে তা হবে যথাক্রমে (০%, ১৫০%, ২৫০%, ৩০০% ও ২০০%)। ভগ্নাংশের হর এখানে সবসময়ই হবে প্রথমদিনের মৃতসংখ্যা, যেমন তৃতীয় দিনের জন্য ২৫০% এই সংখ্যাটি {(৭-২)/২}×১০০% এই পদ্ধতি ব্যবহার করে পাওয়া সম্ভব। একই পদ্ধতি আমরা অন্যান্য ক্ষেত্রের নিরিখেও ব্যবহার করে গ্লোবাল স্কেলে বিভিন্ন তথ্যের বিন্যাসমূলক প্রতিচ্ছবি দেখতে পাবো। শুধু মৃত্যুর হারই নয়, এইভাবে কত শতাংশ মানুষ দিনপ্রতি সুস্থ হচ্ছেন, কোন কোন বয়সের মানুষ কিভাবে কত শতাংশে আক্রান্ত হচ্ছেন, ইত্যাদি আরও অসংখ্য 'ক্যালকুলেটেড ফিল্ড' তৈরী করা যায়। উল্লিখিত উদাহরণটিতে আমরা সংখ্যাভিত্তিক তথ্য বা নিউমেরিক্যাল ডেটা নিয়ে কথা বলেছি, প্রচুর বৈশিষ্টমূলক বা ক্যাটেগোরিক্যাল তথ্যও পাওয়া যায়, যেমন মানুষের খাদ্যাভ্যাস, দেশের নাম ইত্যাদি সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। এই ধরণের তথ্য দিয়েও বিশ্লেষণের প্রচুর পদ্ধতি রয়েছে। সাধারণ গাণিতিক উপায়ে ছাড়া, নিউমেরিক্যাল ক্যাটেগোরিক্যাল দুরকম তথ্যের ক্ষেত্রেই জটিল বা বিষয়ভেদে অতিজটিল গাণিতিক মডেলের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে, যা অনেক সময় ফোরকাস্ট বা প্রেডিকশনের জন্য ফলপ্রসূ হয়ে ওঠে।
গ্রাফ
শুধুমাত্র এঁকে ফেললেই হয় না, গ্রাফ যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণের শক্তিও থাকা চাই। একটি
সাধারণ উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। নীচে আমরা ১ থেকে ১০ এই দশটি
সংখ্যা কিছু এলোমেলো করে নিয়ে এঁকেছি। এলোমেলো করার কারণ হল, ১-১০ এই সিরিজে
যেহেতু প্রতি সংখ্যাই তাদের আগের সংখ্যার থেকে বড়, তাই কোন পরিবর্তন না করে আঁকলে
এটি একটি ক্রমবর্ধমান সরলরেখা বা মোনোটোনিক ইনক্রিজিং অপেক্ষকে পর্যবসিত হত,
গ্রাফে কোন উঁচুনীচু থাকত না। ঠিক তার পাশে আমরা এই এলোমেলো সিরিজটিকে ১০ দিয়ে গুণ
করে এঁকেছি। আমার সাজানো এলোমেলো সিরিজটি হল এইরকম, (৪,২,১০,৭,৫,৮,৩,৬,১,৯)
লক্ষ্য করার বিষয়, প্রথম গ্রাফে যে সংখ্যামালা আঁকা হয়েছে, তার রেঞ্জ (১-১০), কিন্তু দ্বিতীয় যে ছবিটি আঁকা হয়েছে, তাতে (১-১০) এবং (১০-১০০) দুটি রেঞ্জই একত্রে ধরা হয়েছে, অর্থাৎ মিলিত রেঞ্জ হয়ে গেছে (১-১০০)। রেঞ্জের এই পরিবর্তনের ফলে, প্রথম গ্রাফে দৃপ্তভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা রেখাটি, দ্বিতীয় ছবিতে দশগুণ বড় সংখ্যাদের চাপে একদম মিইয়ে গেছে। একে বলা হয় স্কেলিং এফেক্ট। অর্থাৎ যে দেশের জনসংখ্যা কম, যেমন আইসল্যান্ডে প্রতি মাসে মৃতের সংখ্যা আর চিনের প্রতিমাসে মৃত্যুর সংখ্যা একসঙ্গে এঁকে ফেললে, গ্রাফে চিনের মৃত্যুর সংখ্যা আইসল্যান্ডে মৃত্যুর চেয়ে তুলনাতীতভাবে বড় দেখাবে, কিন্তু চিনের জনসংখ্যা যে আইসল্যান্ডের জনসংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি, সেই তথ্য কোথাও উল্লিখিত থাকবে না। অথচ, নিজস্ব জনসংখ্যার নিরিখে দুটি দেশেই দৈনিক বিন্যাস সমান, অর্থাৎ উচ্চসীমা বা আপার বাউন্ডারি যখন ১০, তখন তার তুলনায় ৪ সবসময়ই ৪০% আবার উচ্চসীমা যখন ১০০, তার কাছে ৪০ মানে সেই ৪০%ই। সেকারণেই প্রথম গ্রাফের নীল লাইন আর দ্বিতীয় গ্রাফের বাদামি লাইন, দুইই দৃশ্যগতভাবে একইরকম, কারণ নিজস্ব রেঞ্জে সাজানো সংখ্যাগুলির শতাংশ অবদান বা পার্সেন্টেজ কন্ট্রিবিউশন, বিন্যাসগতভাবে একই। অর্থাৎ দুটি দেশেরই দৈনিক মৃত্যুহার তাদের নিজস্ব জনসংখ্যার নিরিখে একইরকম জোরালোভাবে আশঙ্কাজনক।
উল্লিখিত
ঘটনাটির কারণে, দেশভিত্তিক তুলনামূলক পর্যালোচনায় শুধু মৃত্যুর সংখ্যা নিলে সঠিক
চিত্র পাওয়া যায় না। তাই নেওয়া যেতে পারে প্রতিটি দেশ ও অঞ্চলের পপুলেশন পার্সেন্টেজ
বা জনসংখ্যার শতাংশ, কারণ শতাংশের উচ্চসীমা সবসময়ই ১০০, তাই স্কেলিং এফেক্টের ভয়
নেই। নীচের ছবিটি থেকে আমরা রিপোর্টেড করোনাভাইরাস কেসেস বা জনসংখ্যার শতাংশের
নিরিখে নথিভুক্ত হওয়া কেসগুলির একটি চিত্র পেতে পারি।
[https://nucleuswealth.com/articles/coronavirus-the-limits-of-forecasting/]
ওপরের এই গ্রাফটিও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, বরং ভুল পথে চালিত করতে পারে। দেখা যাচ্ছে, সবুজ রঙের রেখায় আইসল্যান্ড এই গ্রাফটিতে রিপোর্টেড কেসের শীর্ষে রয়েছে। আইসল্যান্ডের জনসংখ্যা, ইউরোপীয় বা এশিয়াটিক দেশগুলির তুলনায় বহুগুণে কম, তবু আইসল্যান্ডে সবচেয়ে বেশি রিপোর্টেড কেস কি কারণে হতে পারে? এখানে মনে রাখতে হবে, নথিভুক্তিকরণ নির্ভর করছে কতটা যত্নে ও দ্রুততায় ভাইরাসের উপস্থিতির পরীক্ষা হচ্ছে তার ওপর। আইসল্যান্ডে জনসংখ্যা যথেষ্ট কম হওয়ায় মাথাপিছু প্রায় সকলেরই টেস্ট করা সম্ভব হয়েছে। তাই গোটা দেশটির নিরিখে এতগুলি রিপোর্টেড কেস উঠে এসেছে। বহুল জনসংখ্যায় ভারাক্রান্ত দেশ যেমন ভারতে যেহেতু টেস্টিং তুলনামূলকভাবে অনেক কম (প্রতি এক মিলিয়ন মানুষপিছু প্রায় ৪৭৯৬ জন, যেখানে আইসল্যান্ডে এক মিলিয়ন মানুষপিছু টেস্ট হয়েছে দুই লক্ষ মানুষের) তাই ভারতে রিপোর্টেড কেসেস প্রকৃত আক্রান্ত সংখ্যায় চেয়ে অনেক কম তালিকাভুক্ত হয়েছে, তবুও জনসংখ্যা অত্যন্ত বেশি হওয়ায় সেই রিপোর্টেড কেসের সংখ্যাও ফেলে দেওয়ার মত একেবারেই নয়। নথিভুক্ত কেস ও প্রকৃতপক্ষে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যার মধ্যে কেন এত ফাঁক, তার কিছু কারণ নীচে দেওয়া হল;
অপর্যাপ্ত টেস্টিং - সব দেশে টেস্টিং এর যথার্থ পরিকাঠামো নেই
এখনো অনথিভুক্ত হওয়া কেস - কিছু মানুষের ক্ষেত্রে তাঁরা আক্রান্ত হলেও কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। এমন অনেকেই টেস্ট করাতে চাননি, বা ভুল টেস্ট হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, আক্রান্তদের প্রায় অর্ধেক মানুষের কোনরকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নাও দেখা যেতে পারে।
ইচ্ছাকৃতভাবে অনথিভুক্তিকরণ - কিছু দেশের ক্ষেত্রে এই প্রবণতাও লক্ষ্য করা গেছে
করোনা ভাইরাসের তথ্য নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিশ্লেষণের পরিসর রয়েছে টাইম সিরিজ বা সময়সারণীভিত্তিক গবেষণায়। তথ্যাবলীকে তখনই টাইম সিরিজ বলা হয় যখন ইকুইডিসটেন্ট টাইম ইন্ট্যারভাল বা সমদূরত্বের সময়ভেদে তথ্য পাওয়া যায়। এই ইন্টারভ্যাল যেমন দিন মাস বছর হতে পারে তেমনি ঘন্টা মিনিট বা মিলিসেকেন্ডও হতে পারে। করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে এরকম বহু সময় বিভাজনে তথ্যসংগ্রহ করা সম্ভব ও বিশ্বব্যাপী বহু অ্যানালিস্ট বা বিশ্লেষকেরা টাইম সিরিজ মডেলিং এর সাহায্যে ভবিষ্যতের সঠিক ফল গণনা করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
দমবন্ধ
করা এই চাপা সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়েও কয়েক ঝলক সুবাতাস আমাদের ছুঁয়ে যায়। দেশের
মানুষের সংকটে সাধারণ মানুষ তাঁদের যথাসামর্থ্য এগিয়ে এসেছেন, কম্যিউনিটি কিচেন
চলেছে, চলছে বহু জায়গায়। নিজের ভয়ের কারণে হলেও, পাড়ায় কেউ অসুস্থ হলে তিনি যাতে
দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন তার জন্য প্রার্থনা করছে গোটা পাড়া। অক্সফোর্ড
বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা
ক্লান্তিহীন পরিশ্রম করে খোঁজ পেয়েছেন ডেক্সামিথাসন ড্রাগের করোনা মোকাবিলায়
উল্লেখযোগ্য ভূমিকার, যা পরীক্ষা করা হয়েছিল ইংল্যান্ড জুড়ে ১৭৫টি হাসপাতালে প্রায়
বারোহাজার করোনা আক্রান্তের ওপর। এই পরীক্ষায় সাফল্য পাওয়া গেছে, প্রতি ১০০ জনে ৪০
জনের মৃত্যুহার এই ড্রাগ কমিয়ে আনতে পেরেছে ২৮এ। CSIR CDRI Lucknow তাদের
গবেষণালব্ধ ড্রাগ ইউমিফেনোভ্যর (Umifenovir) এর ট্রায়াল টেস্টিং করার অনুমতি
পেয়েছে। যদিও এটা ঠিকই এই ভাইরাস ভোজবাজির মত এই পৃথিবী ছেড়ে হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে
যাবে না, এই ভাইরাস নিয়েই আপাতত চলতে হবে, তবু যদি এই জাতীয় কোন নিরাময়ের সন্ধান
প্রামাণ্য হিসেবে পাওয়া যায়, তবে সকলকে টিকা দেওয়ার একটা বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা করা
যেতে পারে, ঠিক যেমনটা হয়ে থাকে পোলিও রোগের ক্ষেত্রে। মানবজাতির এই বৃহত্তর
লড়াইয়ের ময়দানে দাঁড়িয়ে দিনের শেষে আমি আশাবাদী। আমরা একসঙ্গে আবার সূর্যাস্তময়
নদী দেখতে যাবো, ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত পথিককে গৃহস্থ আবার এগিয়ে দিতে পারবেন কুঁজোর
ঠান্ডা জল ও দুমুঠো চিঁড়ে গুড়। পিয়ালীকে যে আমি সবিশেষ পছন্দ করে ফেলেছি, এটা ওকে
না জানিয়ে; আমায়, আমাদের সকলকে হেরে গিয়ে এই পৃথিবী থেকে অসহায়ের মত বিদায় নিতে
হবে, এ আমি কখনো অন্তর থেকে বিশ্বাস করি না।
তথ্যসূত্র ও আকর তালিকা
- https://nucleuswealth.com/performance/march-2020-performance/
- https://indianexpress.com/article/explained/explained-how-has-covid-19-affected-the-global-economy-6410494/
- https://coronavirus.jhu.edu/map.html
- https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC7283982/
- https://www.who.int/china/news/detail/09-01-2020-who-statement-regarding-cluster-of-pneumonia-cases-in-wuhan-china
- https://www.thelancet.com/action/showPdf?pii=S1473-3099%2820%2930243-7
- https://www.worldometers.info/coronavirus/
- https://www.bbc.com/news/health-53096736
- https://www.financialexpress.com/lifestyle/health/covid-19-treatment-good-news-csir-cdri-lucknow-gets-approval-for-trial-of-drug-umifenovir/1996160/
- https://www.thebetterindia.com/topics/coronavirus/
ভালো লাগল বেশ। অনেককিছুতে আলোকপ্রাপ্ত হলাম। সংখ্যাতত্ত্বকে কীভাবে নানারকম পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করলে বিশ্বব্যাপী এই মারণরোগের এলাকা ও জনঘনত্বের নিরিখে দ্যাখা যায়, তা আমরা এই লেখা থেকে বুঝতে পারি। এই লেখাটা আগে যেসব লেখা পড়েছি তা থেকে বেশ আলাদা, যেখানে লেখক নিজস্ব পড়াশোনা ও কাজের ক্ষেত্রটির ওপর জোর দিয়েছেন। আমার মনে হয়, রেহেল টিম এইরকম লেখাই চেয়েছে বিভিন্ন পেশার মানুষের কাছে। এতে একটা বিষয়কেই নানা কৌণিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দ্যাখা যায়, বোঝা যায়। সাবাস, এই সমৃদ্ধ লেখার জন্য। ভালো থেকো হিন্দোল।
ReplyDeletePost a Comment