বাংলার চিত্রচর্চায় দেবাশিস সাহা এক উজ্জ্বল নাম। চিত্রের বিবিধ মাধ্যমে তাঁর অনায়াস যাতায়াত।  চিন্তনশীল, সমাজ সচেতন এই চিত্রশিল্পী তুলিতে ধরে রাখেন তাঁর গভীর চেতন রং।

টুকরো টাকরা ভাবনা। সময় অতিমারী!

দেবাশিস সাহা

 

বসেই আছি। আর ভাবছি। নানারকম ভাবনা মাথায় আসছে। মানুষ, প্রকৃতি, প্রাণ, প্রাণী এসব নিয়ে ভাবছি। পৃথিবী, প্রান সৃষ্টির কথা এসব মাথার মধ্যে তাল পাকাচ্ছে। অতিমারী! সারা বিশ্বের মানুষ থেমে আছে। করোনা নামক এক ভাইরাস পৃথিবীর মানব সভ্যতাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। তার জের হিসেবে লকডাউন। ঘরবন্দি।


কয়েকজন বন্ধু ফোন করেছে। বলছে তেড়ে ছবি আঁকো। সিরিজ করে ফ্যালো। অনেক সময় পাওয়া গ্যাছে। কিন্তু কী আঁকব! কীভাবে আঁকব! এসময় তো আমি চাইনি। এসময় তো আমার না। এক চাপিয়ে দেওয়া সময়। না সেভাবে ছবি আঁকতে পারছি না। প্রথম দিকে তো পারিইনি কিছু ছবি আঁকতে। পরবর্তী সময়ে অবশ্য আস্তে আস্তে ছবির কাছেই ফিরেছি।


সুরজিৎ দাশগুপ্তর লেখা একটি বই থেকে প্রথম জানতে পেরেছিলাম ইতালি রেনেসাঁর ঠিক শুরুর দিকে ভয়ানক মহামারীর কবলে পড়েছিল। যা black death নামে খ্যাত। সারা ইউরোপ জুড়ে প্লেগের তাণ্ডবে জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মারা গেছিল। ঠিক এই সংকটের সময়ে ইতালিতে সাহিত্যে চিত্রশিল্পে ভাস্কর্যে নতুন নতুন প্রতিভার আবির্ভাব হয়। সবচেয়ে বিখ্যাত দুজনের নাম দান্তে ও পেত্রার্ক। কেন এই রেনেসাঁ হয়েছিল তার বেশ কিছু ব্যাখ্যা আছে। তার মধ্যে বিনিয়োগই প্রধান কারণ। তাহলে সংকটকালেও শিল্প সংস্কৃতির উন্নতি হয় একথা মনে হয় ঠিক। যদিও পরবর্তী কালে আরও মহামারী অতিমারী হয়েছে কিন্তু তার সাথে শিল্প সংস্কৃতি কতটা জড়িয়ে পড়েছিল তা অবশ্য আমার জানা নেই।


তবে চারপাশে যা দেখা বা শোনা যাচ্ছে অবশ্যই সোস্যাল মিডিয়ার দৌলতে, তাতে দেখতে পাচ্ছি এই শিল্প মাধ্যমকেই মানুষ বেশি করে আঁকড়ে ধরেছে। তবে এইভাবে আরেকটা রেনেসাঁ হবে নাকি জানিনা।

আপাতত মানুষকে বেঁচে থাকতে হবে। এখন সেই লড়াই চলছে। সারা পৃথিবীতে সংকট। এরকম একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাব কখনও ভাবতেই পারিনি। এরপর কী হবে জানিনা।


অনেক মানুষ কাজহীন। তাঁরা আগামী দিনে কীভাবে চলবে বুঝতে পারছেনা। অনেকেই এখন আর করোনাকে ভয় পাচ্ছে না। সংসার কীভাবে চলবে তাই নিয়ে ভীত। তাঁরা আবার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজে ফিরতে চাইছে। উভয় সংকট!


লকডাউনের শুরুতে বেশ কয়েকজনকে বলতে শোনা গেল back to basic. কীসের back to basic !? অত সহজ! এ পৃথিবী কতো মহামারী অতিমারী দেখেছে ? বেশ কয়েকটা। কতোবার মানুষ পেছন ফিরে তাকিয়েছে? কেউ বলছেন এই সময়ে ঘরে থেকে নিজেকে চিনুন। একটা আতঙ্ক নিয়ে মানুষ ঘরে বন্দি হয়ে নিজেকে কীভাবে চিনবে? মানুষ নিজেকে চেনে ঘর আর বাইরের সাথে তাল মিলিয়ে।


মাঝে মাঝে মনে হয় মানুষই সবচেয়ে বেমানান প্রাণী এই পৃথিবীতে, নাহলে মানুষকে এতো কেন লড়তে হবে প্রকৃতির সাথে ??!! কোথাও অন্য কোনো প্রাণীর তো এতো লড়তে হয়না! হয় কী?

কিছু মানুষ দিশেহারা। তাঁরা বুঝতে পারছেন না তাঁরা কাকে বিশ্বাস করবেন। রাজনৈতিক নেতা, বিজ্ঞান না ভগবান। তবুও এসবের পরেও মানুষ নিশ্চয়ই পথ পেয়ে যাবে। কোথাও পড়েছিলাম, barricade close the road but open the way.


Social site আরও সক্রিয় হল এই সময়ে। এতটাই সক্রিয় হল যে ফেসবুকের জনক জুকেরবার্গ বিশ্বে তৃতীয় ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হল এই কয়েকমাসে বিশাল অঙ্কের অর্থ উপার্জন করে। শোনা যায় এই প্রতিকূল পরিবেশে একশ্রেণীর মানুষ ধনী থেকে ধনীতর হয় আর গরিব গরিবতর। আরও একটা খবর শুনলাম কোনও এক দেশের নির্বাচনী প্রচার নাকি এই social site চালাবে। জানিনা এই খবর কতটা সত্যি। তবে ফেসবুক না থাকলে অধিকাংশ মানুষের যে সময় কাটানো মুশকিল হয়ে যেত এ কথা মানতেই হবে।


যেদিন চাকা আবিষ্কার হল সেদিন থেকেই মানুষ যন্ত্রের উপর নির্ভরশীল হয়ে গ্যাছে। অবশ্যই যদি চাকা যন্ত্র হয়ে থাকে। তারপর বহু যুগ পেরিয়ে মানুষ এখন নেটওয়ার্ক সিস্টেমে ঢুকে পরেছে। ডিজিটাল সিস্টেম। বেশ কয়েক বছর ধরে মানুষকে এই সিস্টেমে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া চলছিল। আমাদের দেশে একটি রাজনৈতিক দল এর পক্ষে প্রচার করে যাচ্ছিল। এই অতিমারীর সময় মানুষ ঘরবন্দি হওয়ার ফলে এই প্রচারের এবং প্রয়োগের রাস্তা হয়তো আরও সহজ হবে। যন্ত্র, প্রযুক্তিকে এই সময়ে অস্বীকার করা কখনই সম্ভব নয়। সেটা স্বতঃস্ফূর্ত হওয়াই ভালো।


আর একটা ব্যাপার খুব অদ্ভুত লাগল। এই শ্রমিকদের নিজের নিজের রাজ্যে পাঠিয়ে দেওয়া। কী জঘন্যতম কাজ! এক রাজ্যের মানুষের দায়িত্ব আর এক রাজ্য নেবে না!! রোগ ছড়ানো না ছড়ানোর প্রশ্ন পরে। আমি কোনোদিন রাজনীতি করিনি। কিন্তু সাধারণ মানুষ হিসেবে আমি এর মতো জঘন্য সিদ্ধান্ত আর কখনো দেখিনি। শুনিওনি। এইসব সিদ্ধান্ত কী নির্দেশ করছে !? কী সেই ভয়ঙ্কর নির্দেশ ?!


এসবের মধ্যে ফাঁক পেয়ে হঠাৎ একটা ঝড় এসে গেল। সাধারণত এসব প্রাকৃতিক ব্যাপার স্যাপারে, শুধু প্রাকৃতিক ব্যাপারে কেন, আরও অনেক ক্ষেত্রেই ধ্বংসের হাতছানি বা ধ্বংস হয়ে থাকলেও তার মধ্যে কোথাও যেন একটা রোমান্টিসিজম কাজ করে। অনেক বছর আগে কোথাও এক জায়গায় এক পেট্রল ট্যাঙ্কারে আগুন লাগা অবস্থায় দেখেছিলাম খুব কাছ থেকে। গলগল করে আগুন আর ধোঁয়া বেরোচ্ছিল। সে অসম্ভব এক ধ্বংসাত্মক রোমান্টিক দৃশ্য। কিন্তু এবারের এই ঝড়, উম্পুন, বেশ আতঙ্কিত করেছে। সন্ধ্যের আগে পর্যন্ত বেশ খানিক সেই রোমান্টিসিজম কাজ করছিল। বাড়ির বাতাবি গাছের প্রবল দুলুনির অল্প সময়ের ভিডিও ফেসবুকে দিলাম। কিন্তু পরিস্থিতি পুরো পাল্টে গেল সন্ধ্যার পর। এ ভয়ঙ্কর রূপ, প্রকৃতির আগে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। মনে হচ্ছিল আমি আর প্রকৃতির এক নিরবচ্ছিন্ন গর্জন ছাড়া পৃথিবীতে আর কিছু নেই। 


এক সাথে এইসব দেখতে দেখতে এখন বেশ অসহায় লাগছে। সব মানুষ অসহায়। এই মুহুর্তে মানুষই অসহায়। আমার মনে হয় প্রাণী মাত্রই অসহায়। এই অসহায়তা কাটিয়ে ওঠা আর এক রোমান্টিসিজম।



Post a Comment from facebook

1 Comments

  1. বা! বেশ লাগল। একজন শিল্পীর ভাব-ভাবনা-দেখা ও তার প্রতিক্রিয়ায় ভরা এই লেখা। কোলাজ করা। যেমন সে চিত্রপটে কোলাজ করে, তেমনি এখানে অক্ষরের কোলাজ। উৎকণ্ঠা নিয়ে কতরকমের ভাবনা যে এসেছে প্রসঙ্গক্রমে, সঙ্গে এসেছে এক শিল্পীর চিন্তা-চেতনা, দেখা থেকে অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞতা থেকে দর্শন, এবং শেষাবধি আত্মপ্রত্যয় সমস্ত মানবজাতির হয়ে, তা পড়তে পড়তে এই মনে হয়েছে, শিল্পী অন্য কোনো গ্রহের জীব নয়। আর বেশ কয়েকটা ছবি, এ লেখাকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গেছে। চাকা, সভ্যতার সঙ্গে যার নিগূঢ় সম্পর্ক, সেই চাকা। চাকা একা নয়। তিনি এসেছেন, একটা হাতে-টানা-রিক্সোর বেশে, মানব-শ্রমের র‍্যাপার জড়িয়ে, বিভিন্ন কৌণিক দৃষ্টিভঙ্গির তুলি আর কালো রং নিয়ে। অভিভূত হতে হয়। খুব ভালো হয়েছে। জানতাম, তুমি পারবে। খুব ভালো থেকো ভাই।

    ReplyDelete

Post a Comment

Previous Post Next Post