ওমানের রাজধানী মাসকটে থাকেন পেশায় উচ্চপদস্থ বেসকারী-চাকুরে রোহন। কবি-গল্পকার-গদ্যকার-সম্পাদক-প্রকাশক। সাহিত্যে কবিতা দিয়েই যাত্রাশুরু। নানা ব্যস্ততার মধ্যেও ভিন্নধর্মী নানা লেখাপত্রে নিজের জাত চিনিয়ে চলেছেন।

লকডাউনে সফো

রোহণ কুদ্দুস

 

ঘরবন্দি থাকার জন্যে আমার মতো ঘরকুনোর বিশেষ অসুবিধে হবার কথা কোনোকালেই ছিল না। তাই ওমানে করোনার চোখরাঙানি শুরু হতেই আমি গ্যাঁট হয়ে নিজের সোফাটিতে বসে টিমের আর সবাইকে অফিসে যেতে নিষেধ করে দিলাম। অফিস বলতে ক্লায়েন্ট অফিস। ওমানের রাজধানী মাসকটে আমাদের প্রোজেক্ট চলছে। তিনটে ব্যাঙ্কে তিনটে টিম। আমার টিমের দশজনের একজন মাত্র থাকে অফিসের কাছে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তার দায়িত্ব অফিসে গিয়ে বাকি সবার কম্পিউটার অন করে এক-এক করে সবাইকে নিজেদের মেশিনের রিমোট কনট্রোল দেওয়া। অতিরিক্ত নিরাপত্তার খাতিরে ব্যাপারটা স্বয়ংক্রিয় নয় তখনও। অবশ্য কিছুদিন পরেই আমার ক্লায়েন্টই ব্যবস্থা করলেন বিশেষ ভিপিএন কানেকশনের। 

মাসকটে কিন্তু ভারতের মতো পুরোপুরি লকডাউন হয়নি কখনও। কিন্তু এই যে আমরা বললাম, অফিস যাব না। তাঁরা জোর করলেন না। তাঁদের নিজেদের কর্মীরা লাগাতার অফিসে যাচ্ছেন। এখনও। সোশাল ডিসটান্সিং মানতে দুটো শিফটে কাজ করেন তাঁরা। একদল যান সকাল আটটায়। দুপুর একটায় তাঁদের ছুটি হলে দ্বিতীয় দলের কাজ শুরু হয়। এই দেশের সব অফিসেই মোটামুটি কাজের এই মডেল চলছে। শপিং মল বন্ধ। মুদি দোকান আর খাবার জায়গাগুলো বাদে বন্ধ আর সব দোকান। যে কোনও জায়গায় প্রকাশ্যে দুজনের বেশি জমায়েত করলে মোটা অঙ্কের জরিমানা অবধারিত। 

যাই হোক, শুরু করেছিলাম আমার বাড়ির বাইরে না বেরোনো দিয়ে। ব্যাঙ্গালোরে থাকতে মুদিবাজারটাও অনলাইন সেরে নিতাম। এখানেও আমার দুই রুমমেট— কন্নড় আর ওড়িয়াই এসব কাজ করে। তারা দুদিন ছাড়া পাশের স্পার সুপার মার্কেট থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে আনে আর গল্প শোনায় রাস্তাঘাট কতটা শুনশান। কোথায় কাদের ক্রিকেট খেলার জন্যে পুলিশ পাকড়েছে। যেদিন থেকে স্বেচ্ছাবন্দি হলাম, তার প্রায় ৫-৬ দিন পরে সরেজমিনে দেখতে বাইরে বেরোলাম। সত্যিই রাস্তাঘাট ফাঁকা। আমার পোষ্য পচ্ছপের জন্যে লেটুস পাতা কেনার দরকার ছিল। তাই গেলাম স্পারে। তারা সোজা হাঁকিয়ে দিল। মাস্ক না হলে ঢুকতে দেবে না। ব্যাপারটা নতুন চালু হয়েছে তখন। তাদের শাপ-শাপান্ত করতে করতে পাশের আরেকটা সব্জির দোকান থেকে লেটুস কিনলাম। তারা ছোট ব্যবসায়ী, তাই এইসব সৌখিন ব্যাপার-স্যাপার তারা তখনও আয়ত্ত করেনি।

এই মাস্কের ব্যাপারটা তখনই শেষ হল না যদিও। সেইদিন রাতেই ওড়িয়া আবার গেছে স্পারে। সকালের ব্যাপারটা তাকে বলেছিলাম। তবু সে আশায় বুক বেঁধে গিয়েছিল, রাত এগারোটায় হয়তো কেউ খেয়াল করবে না। কিন্তু তাকেও পাত্তা দিল না স্টোরের সিকিউরিটি গার্ড। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে মাথা খাটিয়ে ওড়িয়া একটু অন্ধকার মতো জায়গায় টিশার্টের ভেতর থেকে স্যান্ডো গেঞ্জি খুলে মাস্কের মতো করে মুখে বেঁধে আবার চেষ্টা করল ভেতরে ঢোকার। সাতজন্মে না ধোওয়া সেই তেলচিটে হলুদ গেঞ্জি দেখে দোকানের ক্যাশিয়ার থেকে দারোয়ান সবার সে কী হাসি। শেষে তারা হুমকি দিল পুলিশ ডাকবে। ওড়িয়া ফিরে এসে করুণ মুখে আমায় আর কন্নড়কে সেই প্রত্যাখ্যানের গল্প শুনিয়ে সিদ্ধান্ত নিল নিজেই মাস্ক বানাবে।

পরদিন শনিবার। সকাল-সকাল উঠে কাপড় কাচতে দেব বলে ওয়াশিং মেশিন খুলে আবিষ্কার করলাম আমাদের ফ্ল্যাটের কাপড়ের তিনটে পাপোষ পুঁটলি করে ঠাসা তার মধ্যে। সামান্য চেঁচামেচির পরে জানা গেল, ওড়িয়ার ডি-ওয়াই-আই প্রোজেক্ট এটা। পাপোষ কেটে মাস্ক বানাবে সে। যাই হোক, সে যাত্রা ডিসপোজেবল মাস্ক কিনে আমরা সভ্যতার মূলধারায় ফেরত এলাম।

তা এসব হল মাস আড়াই আগের কথা। এর মধ্যে গঙ্গা-পদ্মা দিয়ে বহু জল বয়ে গেছে। আমাদের ফ্ল্যাটে ঘরদোর পরিষ্কার করে দিতে আসেন রফিক ভাই। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রাম। মাসকটের একটা ব্যাঙ্কের হাউসকিপিং টিমে কাজ করতেন। এখনও করেন। মানে অফিস যান। কেউ থাকুক না থাকুক। টেবল-চেয়ার ঝেড়েঝুড়ে ইনডোর প্ল্যান্টে জল দিয়ে আসেন। কিন্তু তাঁর অফিস জানিয়েছে এখন আর মাইনে দিতে পারবে না। কবে দিতে পারবে তার কোনও ঠিক নেই। তবু রফিক ভাই তাঁর কাজ করে চলেন। হয়তো আবার মাইনে পাবেন এই ভাবনায়। এসব শুনে-টুনে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, “বাড়িতে কিছু পাঠাতে পেরেছেন?” তিনি নিঃশব্দে মাথা নাড়লেন। আমাদের ঘর-টর পরিষ্কার করে দিয়েও সামান্য কিছু আয় হয় তাঁর। তাই বললাম, “আপনি তিনমাসের আগাম টাকা নিয়ে নিন। পরে কাজ করে শোধ করে দেবেন।” টাকা তো দেওয়া হল। কিন্তু সে টাকা বাড়ি পাঠাবেন কী করে? মানি এক্সচেঞ্জগুলো বন্ধ। অগত্যা আমার নেট ব্যাঙ্কিং থেকে রেমিটেন্সই ভরসা। সেটাও অবশ্য কাজ করেনি। পরে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের এক পুরনো বন্ধুকে ধরে-করে তাঁর বাড়িতে টাকা পাঠানো গেল। রফিক ভাইয়ের মতো হাজার-হাজার ভারতীয় উপমহাদেশের শ্রমজীবী মাসকটের রাস্তাঘাটে কাজ হারিয়ে ঘুরছেন। তাঁদের বাড়ি ফেরার উপায় করেছেন দেশের সরকার বাহাদুর। বাংলাদেশের কথা জানি না। ভারতীয় এমব্যাসি থেকে অনলাইন ফর্মের ব্যবস্থা করা হয়েছে দেশে ফেরার আবেদন জমা নিতে। এক-দুদিন ছাড়া এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট ওমানে আটকে পড়া ভারতীয়দের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সেও হয়ে গেল প্রায় দেড় মাস। গালফের নানা দেশ থেকেই ভিসা শেষ হওয়া, চাকরি খোয়ানো ভারতীয়দের নিয়ে বিশেষ কিছু লেখালেখি হতে দেখিনি কোথাও। দেশের মধ্যে এক রাজ্য থেকে আর-এক রাজ্যে বাড়ি ফিরতে চাওয়া শ্রমিকদের থেকে কিছুমাত্র কম নয় এই মানুষগুলোর দুর্দশা। প্রতিটি ফ্লাইটে আসন সংখ্যা সীমিত হওয়ার কারণে এঁরাও অপেক্ষায় আছেন কবে দেশের মাটিতে পা রাখবেন। দারুণ কষ্টের মধ্যেও রফিক ভাইয়ের মতো কেউ কেউ আবার ফিরতেও রাজি নন। যদি অবস্থা আবার স্বাভাবিক হয়। যদি আবার মাইনে চালু হয়। দেশে অনেকগুলো মুখ তাঁর রোজগারের দিকে তাকিয়ে।

আমিও নাম লিখিয়েছিলাম ওই দেশে ফিরতে চাওয়া মানুষগুলোর দলে। কিন্তু সুযোগ এখনও আসেনি। ভারতীয় দূতাবাস জানিয়েছেন তাঁরা ফোন করবেন বা মেল করে জানাবেন। অপেক্ষায় আছি। কয়েকদিন আগে ভারতে জন্ম নিয়েছে আমার দ্বিতীয় সন্তান। ইমন। আবাহনের রাগ সে। মহামারী লাঞ্ছিত এই পৃথিবীতে আরও কিছুদিন যুঝে যাওয়ার ইন্ধন পাই। বিক্ষিপ্ত অশান্তিতে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সন্তানের মুখ ধরে চুমো খাওয়ার কথা মনে পড়ে যায়। এই অশান্ত পৃথিবীতে এইটুকুই প্রলেপ এখন— ভাঙাচোরা যাপনের মধ্যে দিয়ে চোরাগোপ্তা আলো চুঁইয়ে পড়া।



Post a Comment from facebook

3 Comments

  1. খুব সুন্দর লেখা হয়েছে। কোনো জটিলতা সৃষ্টির চেষ্টা নেই। কথা বলে যাওয়ার মতো সহজ-সরল পথে এর উপস্থাপনা। কিন্তু একটা ভিন্ন দেশের একটা স্থানের চিত্র ফুটে উঠেছে দারুনভাবে। আবার বিভিন্ন স্তরের প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়েও কথা আছে। তাদের সমস্যা, কাজ হারানো, আর্থিক অনটন ইত্যাদি উঠে এসেছে। আরেকটা গভীর সমস্যার কথা উঠে এসেছে যা আমাদের দেশে প্রায় অনালোচিত। সেটা হলো গালফ-এরিয়ায় ভারতীয়দের কাজ-হারানো আর দেশে ফেরার বিষয়টি। রোহনের গদ্য লেখার নিজস্ব একটা ভঙ্গি আছে। এই বিষয়ে লিখতে গিয়ে সে হঠাৎ করে বেশি সিরিয়াস ও গুরুগম্ভীর না-হয়ে পড়ে, তার সরস ভাবটিই বজায় রেখেছে। লেখাটা শেষ হয়েছে বিশ্বজোড়া মৃত্যুমিছিলের মধ্যে একটি মানব-প্রাণ ভূমিষ্ট হওয়ার মধ্যে, যা প্রতীকী এবং শাশ্বত। ব্র্যাভো, রোহন। ভালো থেকো। আর অপেক্ষায় থাকো, কবে তোমার দরখাস্ত মঞ্জুর হয়!

    ReplyDelete
  2. বাইরে থাকি আমিও। তবে দেশের বাইরে নয়। আপনার লেখার সাথে নিজেকে রিলেট করতে পারলাম।

    ReplyDelete

Post a Comment

Previous Post Next Post